'ওয়ার্ক ফ্রম হোম' নতুন বিষয় নয়
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক উপায় হিসেবে সামাজিক বা শারীরিক দূরত্বকে অত্যধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্বকে নিশ্চিত করার জন্য ওয়ার্ক ফ্রম হোমকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এই উপায়টির মূল কথা হচ্ছে কর্মস্থলে না গিয়ে বাড়িতে অবস্থান করে নির্ধারিত কাজ করে তা ইলেক্ট্রনিক উপায়ে অফিসকে বুঝিয়ে দেওয়া।
আগে কাজ হতো অফিসে বসে। আর, এখন কাজ হবে বা হচ্ছে বাড়িতে। ফলে, অনেকের কাছে ‘অফিস’ ও ‘বাড়ি’-এর মধ্যেকার পার্থক্য দৃশ্যমান হচ্ছে। কেউ কেউ হয়তোবা বাড়িতে কাজ করাকে চ্যালেঞ্জ মনে করছে। বাড়িতে অফিসের পরিবেশ তৈরিতে হিমশিম খাচ্ছেন। হয়তোবা, বহু মানুষ এই ব্যবস্থার সাথে তাল মিলাতে না পেরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। বস্তুত, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বা ‘বাড়িতে বসে কাজ’ করা নতুন কোনো বিষয় নয়। করপোরেট বা ব্যাংকিং সেক্টরে এটি সাম্প্রতিক ঘটনা হলেও অর্থনৈতিক বহু ক্ষেত্রে এই ধারণাটি খুবই পুরনো। এ সম্পর্কে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি।
কৃষকেরা বাড়িতে অবস্থান করেই কাজ করেন। বাড়ির সাথে তাদের কৃষি জমির দূরত্ব পায়ে হাঁটা পথের। বাড়িতেই শস্য দানা থেকে তারা বীজ তৈরি করেন। বাজার থেকে সার ও কীটনাশক ওষুধ কিনে বাড়িতেই রাখেন। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, যেমন লাঙ্গল বা ট্রাক্টর, কোদাল, নিড়ানি, ইত্যাদি বাড়িতেই থাকে। কৃষি উপকরণগুলো বাড়ি থেকে কৃষি জমিতে নিয়ে যান আবার বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসেন। ফসলি জমির আগাছা কেটে বাড়িতে নিয়ে এসে গৃহপালিত গরু ও ছাগলকে খেতে দেন। ফসল তুলে তা বাড়িতে নিয়ে আসেন। ফসল মাড়াইয়ের কাজ জমিতে বা বাড়ির উঠানে করা হয়। শস্য বাড়ির উঠানে শুকানো হয়। বাড়িতেই তা সংরক্ষিত করে বাজারে বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। যুগের পর যুগ ধরেই কৃষকেরা বাড়িতে কাজ করে আসছেন। তাদেরকে বাড়ি ও কর্মস্থানের মধ্যেকার পার্থক্য তৈরি করার প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য, শিল্পায়িত কৃষিকাজের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।
শিক্ষকতা পেশায় বাড়িতে অবস্থান করে পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা, ক্লাসে পাঠদানের বিষয়ের উপর প্রস্তুতি নেওয়া এবং প্রাইভেটে ব্যাচ পড়ানো খুবই পুরনো বিষয়। বহু শিক্ষকের গৃহে পৃথক পড়ার ঘর আছে যেটি তাঁদের কাজ করার জায়গা। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণা কাজে নিয়োজিত রাখতে হয়। তাদের গবেষণা সংশ্লিষ্ট চিন্তা-ভাবনাগুলোকে তত্ত্বাবধান করতে হয়। গবেষণার থিসিস বা সিদ্ধান্তকে সংগঠিত করতে প্রয়োজন পড়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দীর্ঘ সময়ের আলোচনা, যুক্তিতর্ক ও বোঝাপড়া। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো নির্দিষ্ট অফিস ঘণ্টার মধ্যে সীমিত রাখা সম্ভব হয় না। তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বাড়িতে এসে তাদের গবেষণা সম্পর্কে পরামর্শ নেয়-এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য শিক্ষা-সংস্কৃতি।
বহু চিকিৎসকরা হাসপাতাল থেকে ফিরে সন্ধ্যার পর স্বগৃহে চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। বহু চিকিৎসক আছেন যাদের বাড়িতে একটি নিজস্ব চেম্বার আছে যেখানে স্থানীয় রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। আবার বাড়ির পাশেই ওষুধের দোকানে রোগী দেখেন। আমার এক বন্ধুর বাবা আছেন যিনি উপজেলা পর্যায়ের একটি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ছিলেন। হাসপাতালের সাথেই লাগোয়া সরকারি আবাসনে তিনি থাকতেন। তাকে দেখেছি যে তিনি বাড়িতেই গরীবদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতেন। এছাড়াও, যারা মানবতাবাদী চিকিৎসক তাদের কাছে বাড়ি ও অফিস-এর পার্থক্য নেই। যেখানেই প্রয়োজন সেখানেই কাজে লেগে পড়েন। যেমন, চিকিৎসক এডরিক বেকারের কথা বাংলাদেশের অনেকেই জানেন। তার বাড়ি ছিল নিউজিল্যান্ডে। দরিদ্রদেরকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার স্বপ্ন পূরণে তিনি বাংলাদেশে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুরে স্বাস্থ্য কেন্দ্র চালু করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ড: বেকার গরবীদেরকে বিনামূল্যে ও নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন। তার কাছে গৃহ ও কাজের জায়গার মধ্যে সুনির্দিষ্ট ফারাক ছিল না।
গ্রামীণ সমাজে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছেন যাদের দোকান ও বাড়ি একই ছাদের নিচে। ঘরে দোকানের মাল (চাল, আলু, রসুন, তেল) গৃহে থাকে। দোকান ঘরে স্বল্প পরিমাণে রেখে সেগুলি খুচরা বিক্রয় করেন। আবার বহু শিক্ষিত যুবক আছেন যারা চাকরি না করে বাড়িতেই মুরগির, গরুর, ছাগলের বা মাছের খামার করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। স্থানীয়রা মুরগি ও ডিম বাজারে না গিয়ে প্রতিবেশী খামারি বাড়িতেই গিয়ে কিনতে পারে। ফলে, খামারি পেশার লোকদের কাছেও বাড়ি ও কাজের জায়গা একই।
গৃহকর্ত্রীরা গৃহস্থালির কাজ গৃহের ভিতরেই করেন। বলা বাহুল্য, তাদের কাজগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বা আর্থিকভাবে মূল্যায়িত করা হয় না। গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য না থাকলেও তাদের কাজগুলো অমূল্য এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জীবনে এর ইতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। করোনা পরিস্থিতি বা অন্য যেকোনো দুর্যোগই আসুক না কেন তাদের কাজ একই থাকে এবং একই স্থানে অর্থাৎ বাড়িতে সম্পন্ন করতে হয়। ফলে, গৃহকর্ত্রীদের জন্য বাড়িতে বসে কাজ নতুন কোনো বিষয় নয়। এছাড়াও, বহু নারী আছেন যারা গৃহকর্ত্রী আবার বাড়ির ভিতরেই কাপড় সেলাই বা বিউটি পার্লার পরিচালনা করেন।
গাড়ীর চালক, সুপারভাইজার ও হেল্পারদের কাছে অনেক সময় গাড়িই বাড়ি হয়ে দাঁড়ায়। যারা আন্তঃজেলায় যাতায়াত করেন তারা লক্ষ্য করেছেন যে যে চালক, সুপারভাইজার ও হেল্পারদেরকে রাতের ভ্রমণে জেগে থাকতে হয় এবং সকালে তারা, বিশেষ করে হেল্পার, গাড়ির ভিতরেই ঘুমায়, কাউন্টারের টয়লেট ব্যবহার করে, বাইরের হোটেলে খায়। তাদের কাজ স্বগৃহের বাইরের করতে হয় বিধায় গাড়িই তাদের চলমান বাড়ি। এছাড়া, আবাসিক এলাকার বহুতল বিশিষ্ট ভবনগুলোতে নিরাপত্তাকর্মীরা কাজ করেন। যাদের অনেকেই ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটি ঘরে থাকেন। কোনো কোনো ভবনের নিচে তাদের ব্যবহারের জন্য টয়লেট ও রান্নাঘর আছে। ফলে, ভবনের নিচেই তার বসবাস ও কাজ করার জায়গা।
নিঃসন্দেহে, অফিসের পরিবেশে যারা এতদিন কাজ করে অভ্যস্ত তারা বাড়িতে কাজ করাকে সমস্যাজনক ও অস্বাভাবিক মনে করছে। উপরের উদাহরণগুলো দেখায় যে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ আমাদের দেশের অসংখ্য মানুষের কাছে খুবই স্বাভাবিক। এটি যাদের কাছে চ্যালেঞ্জ বা সমস্যাজনক হিসেবে দাঁড়িয়েছে তারা উপরের উদাহরণগুলিকে বিবেচনায় আনতে পারেন। এতে করে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হবে-যেটি করোনাকালীন দুর্যোগ মোকাবিলায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ড. মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।