করোনা, বিদ্যাসাগরের চটি জুতা এবং একটি বইপাঠের অভিজ্ঞতা
বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) মহাশয় খুব তেজি মানুষ ছিলেন। একটা জিনিস উনি বুঝেছিলেন। যে সময়ে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেসময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনের বিরুদ্ধে স্বজাতির মাথা তোলার কাজে সহায়তা করতে হলে তেজ জিনিসটাই বড় সম্বল। কিন্তু বিদ্যাসাগর শুধু তেজ নয় সাথে যোগ করেছিলেন জ্ঞানসাধনার কাজটিও। বিদ্যা যে বড় শক্তি সেটা বিদ্যাসাগর নিজে যেমন বুঝেছিলেন তার জাতিকেও বোঝাবার ভারবাহি কাজটা হাতে নিয়েছিলেন। বাঙালির চেতনা জাগ্রত করার জন্য শিক্ষকতা করেছেন, বই লিখেছেন, সমাজ সংস্কারক হিসেবে বই-পুস্তকের বিশেষ করে ধর্ম পুস্তকের জ্ঞানকে ব্যবহার করে জাতির ভেতরের মজ্জাগত সংস্কার আর কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে আলো জ্বালিয়েছেন।
জাতির যে কোন বড় বিপদে, তেজ বা সাহস আর জ্ঞান যে বড় শক্তি আজ এই করোনাকালে আমরা সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। করোনা মোকাবিলায় আমাদের ব্যবস্থাপনাজনিত সংকটের চেহারা বিশেষ করে আমাদের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার দিকটি দিন দিন যেভাবে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে, তাতে এটা এখন সুস্পষ্ট- ডাক্তার-হাসপাতাল-অবকাঠামো থাকলেই মানুষ চিকিৎসা পাবে এটা বিশ্বাস করার কারণ নেই।
যা হোক, কথা শুরু করেছিলাম বিদ্যাসাগরকে দিয়ে, সেখানেই আবার ফেরত যাই।
১৮৭৪ সালের ২৮ জানুয়ারি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির অফিসে ঢুকতে যান বিদ্যাসাগর। বরাবরের মত তার পায়ে ছিল চটি জুতা । প্রবেশকালে তাকে বলা হয়, চটি নিয়ে তিনি ঢুকতে পারবেন না। তাকে চটি খুলে যেতে হবে। অপমানিত বোধ করেন বিদ্যাসাগর। ফিরে আসেন। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি। এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সম্পাদক ব্ল্যানফোর্ড সাহেবকে একটা চিঠি লিখেন। তাতে বিদ্যাসাগর লিখলেন, ‘ ...If persons so wearing the shoes of the English pattern, though coming on foot, could be admitted with shoes on, I could not make out why persons of the same status in life and under similar circumstances should not be admitted, simply because they happened to wear native shoes.'
বিদ্যাসাগরের যুক্তি পরিষ্কার। ইংরেজরা তাদের ব্যবহৃত জুতা নিয়ে ওখানে ঢুকতে পারলে সমমর্যাদার স্বদেশিরা কেন তাদের ব্যবহৃত পাদুকা নিয়ে ঢুকতে পারবে না। সাহেবরা অবশ্য পাল্টা যুক্তি টানলেন। বিদ্যাসাগরকে জানানো হল ভারতীয় প্রথা হচ্ছে ঘরে ঢোকার সময় জুতা বাইরে রাখা। তারা সেটাই করতে বলেছেন মাত্র। বিদ্যাসাগর বুঝলেন ইংরেজরা ছল-চাতুরি করছেন। তিনি উত্তর দিলেন, যে ঘরে ফরাশে বসতে হয় সেখানে বাইরে জুতা রাখার রেওয়াজ। যে ঘরে চেয়ারে বসতে হয় সেখানে জুতা বাইরে রাখার দরকার নেই এবং সেটা ভারতীয়দের রেওয়াজও নয়। যদি বুট জুতা নিয়ে ঢোকা যায় তবে চটি জুতা নিয়ে ঢুকতে না পারার কোন কারণ নেই।
ইংরেজ সাহেবরা শেষে বিদ্যাসাগরের যুক্তি মেনে নিতে বাধ্য হন।
দুই.
বিদ্যাসাগর জ্ঞানযোগের কথা পেড়েছিলেন। তার প্রত্যেকটা সামাজিক লড়াইয়ের শক্তি তিনি জ্ঞানযোগ থেকে কর্মযোগে রুপান্তরিত করতেন। এবার করোনার সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি আর বেসরকারিভাবে ঘোষিত লকডাউনে আমাদের এক বন্ধু আলমগীর কবির যার সাংগঠিনক ক্ষমতায় আমরা মুগ্ধ- এক প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন। সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘গ্রীন ভয়েস’ নামে এক পরিবেশবাদী যুব সংগঠন তৈরি করেছেন এই কর্মবীর বন্ধুটি। করোনার দুর্ভোগের দিনে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় আটকে পড়া গ্রীন ভয়েসের বন্ধুরা নানারকম ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা কাজ চালিয়ে গেছেন।
আমি পরামর্শ দিলাম এই সংগঠনের সদস্য ও কর্মীদের অনলাইনে বই পড়ানোর সুযোগ করে দেয়া যায় কি না? যেই কথা সেই কাজ। বন্ধুটির উদ্যোগে বইপাঠের অনলাইন ব্যবস্থা করা হোল, ‘প্রয়াস’ নামে একটা ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করে। একটি বইয়ের পিডিএফ এবং জেপিজি ফাইল সেই ফেসবুক গ্রুপে আপলোড করা হোল। নিয়ম করা হোল আপলোডকৃত বইটির ২০ পৃষ্ঠা করে প্রতি সপ্তাহে পড়তে হবে এবং সপ্তাহান্তে ৫ শত থেকে ৭ শত শব্দের মধ্যে পাঠপ্রতিক্রিয়া ওই নির্দিষ্ট ফেসবুক গ্রুপের পেজে লিখে পোষ্ট করতে হবে। আমরা প্রথমে সিলেক্ট করলাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা ৮০ পৃষ্ঠার ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইটি। চার ধাপে এই বইপাঠ এবং বইপাঠের পর পাঠপ্রতিক্রিয়া লেখা চলল। ১৫ এপ্রিল ২০২০ থেকে ১২ মে পর্যন্ত এই অনলাইন বইপাঠ চলে। চারধাপে রিভিউ লেখার শেষ সময় ছিল ১৩ মে ২০২০। বইপাঠের ঘোষণায় বলা হয়েছিল নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা বই পড়বে এবং চারটি পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখে পাঠাবে তাদের মধ্যে সেরা পাঁচজনকে করোনা পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এনে লেখকের সাথে একটা মুক্ত আড্ডার ব্যবস্থা করা হবে।
বইপাঠের এই ঘোষণা সারাদেশ থেকে গ্রীন ভয়েসের সদস্যদের মধ্যে ৪৬৭জন আগ্রহ প্রকাশ করে, তারা এই গ্রুপের সদস্য হোল। বইপাঠ শেষ হলে আমরা একটা মূল্যায়ণ করলাম। আমাদের বিবেচনায় ছয়জনকে আমরা পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন দিতে পারলাম। কথা সেটা নয়, আমার নিজের আগ্রহ তৈরি হল এই বইপাঠকে কেন্দ্র করে, আমাদের তরুণ সমাজের মধ্যে পাঠ আগ্রহের একটা জরিপ করার বিষয়ে।
বলা ভালো, বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতা , দুর্বলতার কারণ অনুসন্ধান, দুর্বলতা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার সুলুক সন্ধানী যেসব বই বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে তার মধ্যে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ রচিত ‘সংগঠন ও বাঙালি’ বইটি অন্যতম। অত্যন্ত মনোরম এবং সুখপাঠ্য গদ্যে, সরস ভঙ্গি বাঙালির সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার এমন চিন্তাজাগানিয়া আলোচনা নিয়ে খুব কম বইই লেখা হয়েছে। বইটির অনেক চিন্তার সাথে ভীন্নমত পোষণ করার সুযোগ আছে, কিন্তু বাঙালির প্রতিষ্ঠান কেন শক্তিমন্তভাবে দাঁড়ালো না, কেন বাঙালি আড়ম্বর দিয়ে শুরু করলেও নিরন্তরভাবে তার কর্মসূচি সাফল্যের সাথে পরিচালনা করতে আজও পারলো না, তার একটা নির্মোহ, বেদনাবহ কিন্তু সরস ব্যবচ্ছেদ এই বইয়ে আছে।
বাংলাদেশে যারাই ছোট-বড়-মাঝাড়ি সংগঠন তৈরির কাজ করতে চান,তাদের জন্য এই বই পড়া অতি আবশ্যক বলেই আমাদের মনে হয়েছে। সেই বিবেচনায় তরুণ শিক্ষার্থীদের পরিবেশবাদি এই সংগঠনের কর্মীদের আমরা এই বইটি পড়তে দিয়েছিলাম।
এই সংগঠনের কর্মীরা যথেষ্ট পরিশ্রমী, মানবিক, উৎসাহী, সামাজিকভাবে সচেতন এবং ডিজিটালি অগ্রগণ্য। এই বইপাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, হাজি দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর সরকারি কলেজ, জয়পুরহাট শহীদ জিয়া কলেজ, রাজশাহী সরকারী মহিলা কলেজ, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহ নিউ গভঃ সরকারি কলেজ সহ দেশের নানান বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থিরা অংশগ্রহণ করে।
অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল এসএসসি পাশ। বলা চলে আগামী দিনের বাংলাদেশ যাদের হাতে গড়ে উঠবে সেই বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থিরাই ছিল আমাদের এই বইপাঠে অংশগ্রহণকারী।
এবার আসি সেই জরিপের কথায়। নিদির্ষ্ট সময় শেষে আমরা দেখলাম ৪৬৭ জন শিক্ষার্থির মধ্যে ৪৯ জন নিয়ম মেনে বইটির ন্যূনতম অংশ পড়েছে এবং ন্যূনতম একটি হলেও পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখেছে। এই ৪৯ জনের মধ্যে নারী অংশগ্রহনকারী ২৫ জন, পুরুষ অংশগ্রহণকারী ২৪ জন। অর্থাৎ নারী অংশগ্রহণকারী ৫১% এবং পুরুষ অংশগ্রহণকারী ৪৯%। বইটি পরিপূর্ণভাবে পড়া এবং নিয়ম মেনে পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে পেরেছেন মাত্র ১৪ জন। অর্থাৎ মোট অংশগ্রহণকারী ৪৬৭ জনের মধ্যে ১৪ জন সাফল্যের সাথে এই কাজটি শেষ করতে পেরেছেন। অর্থাৎ একটি চিন্তাশীল বই পড়া এবং পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখার কাজ সুসম্পন্ন করার যোগ্যতা দেখিয়েছেন মাত্র ৩% অংশগ্রহনকারী। বইপাঠ সুসম্পন্ন করা ১৪ জনের মধ্যে নারী অংশগ্রহণকারী ০৮ জন (৫৭%), পুরুষ অংশগ্রহণকারী ০৬ জন (৪৩%)।বইপাঠপ্রতিক্রিয়ার মূল্যায়নে যে ছয়জন পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন তাদের ৫জন (৮৩%) নারী এবং ০১ জন (১৩%) পুরুষ।
বলা ভালো এই জরিপ একটা জিনিস পরিষ্কার করে দেয় যে, বইপাঠের মত সুচিন্তিত, পরিশ্রমি এবং মননশীল কাজে বাংলাদেশে এখন পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা বহুগুণে এগিয়ে। বইপাঠের মত একটি কাজ যে সহজ নয়, মননশীল একটা বই গড়পড়তা ১০% পড়তে পারলেও ভালোভাবে পড়ার সামর্থ্য এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়া ৩%-এর বেশি মানুষের এখনো তৈরি হয় নাই। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞানচর্চা সামর্থ্যেরএই শক্তিহীনতার দিকেই এখন আমাদের নজর দিতে হবে।
আজ করোনাকালে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নানা সিদ্ধান্তহীনতা ও দুর্বল সিদ্ধান্তের যে ছড়াছড়ি দেখছি, তার বড় অংশ আসছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে শিক্ষা নেয়া দায়িত্বশীলদের কাছ থেকেই। বলা ভালো বইপাঠের এই খুবই ছোট কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ জরিপ থেকেও প্রমাণিত হয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্ঞানযোগের কাজটিতে এখন অনেক মেরামতি দরকার।
করোনা একটি বিশেষ দুর্ভোগ। বলা হচ্ছে, বহু বড় দেশও এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। সেটা ঠিক, হিমসিম খেলেও, বড় দেশগুলো তাদের গবেষণা আর মেধা দিয়েই শেষাবধি এই মহামারিকে পরাভূত করবে। জ্ঞানযোগেই এই দুর্ভোগ পরাভূত হবে। আমাদের কর্মযোগে মানসম্পন্ন জ্ঞানযোগ যতদিন প্রকৃতই যুক্ত না হবে, ততদিন আমাদের মানুষের বড় অংশের জীবনে আমরা স্বস্তি দিতে পারবো না। করোনা আমাদের সেই দুর্বলতার দিকটি আরও স্পষ্ট করে তুলল।
লেখার শুরুতে বিদ্যাসাগরের তেজের কথা তুলেছিলাম। সেই তেজও কিন্তু জ্ঞানযোগ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত ছিল। আমাদের বিদ্যায়তনগুলোতে এই দুটোরও এখন প্রবল অভাব। সেই জায়গাতেও চোখ রাখা খুব জরুরি।
শুভ কিবরিয়িা: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক।