আবুল খায়ের স্টিল লিমিটেডের (একেএস) বিরুদ্ধে শুধু জালিয়াতি নয় গ্যাস চুরিরও তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আলোচিত ওই কোম্পানিটির নামে ন্যূনতম হারে বিল করা হলেও তদন্তে বেশি গ্যাস ব্যবহারের তথ্য উঠে এসেছে।
দুদকের তদন্তে বলা হয়েছে, অবৈধ প্রক্রিয়ার আবুল খায়ের লিমিটেড’র (শিল্প-৬২৪১) লোড বৃদ্ধি কার্যকর করা হয় ২০১৭ সালের ১৮ জানুয়ারি। চালনা ধাঁচ পরিবর্তনের কারণে মাসিক গ্যাস লোড ৩ লাখ ৭১ হাজার ৬০৪ ঘনমিটারের পরিবর্তে ৭ লাখ ৪৩ হাজার ২০৮ ঘন মিটার এবং ন্যূনতম মাসিক গ্যাস লোড ১ লাখ ৮৫ হাজার ৮০২ ঘনমিটারের পরিবর্তে ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৯২৫ ঘনমিটার নির্ধারিত হয়। চালনা ধাঁচ পরিবর্তনের আড়ালে লোড বৃদ্ধি করার আগেই মাসিক ৩ লাখ ৭১ হাজার ৬০৪ ঘনমিটারের পরির্বতে ৭ লাখ ৪৩ হাজার ২০৮ ঘন মিটারে গ্যাস ব্যবহার করার প্রমাণ পায় দুদক। যে কারণে তাদের ন্যুনতম বিলের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের জালিয়াতির তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আবুল খায়ের লিমিটেড (শিল্প-৬২৪১) ন্যূনতম লোডে বিল হওয়ার বিষয়টিও রহস্যজনক। কারণ কোস্পানিটি আগে থেকেই ( আবুল খায়ের স্টিল ও ক্যাটিভ পাওয়ার) বেশি গ্যাস ব্যবহার করে আসছিল। ন্যূনতম লোডে বকেয়া গ্যাস বিলের পরিমান বর্তমানে ২টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে প্রায় ১২ (বার) কোটি টাকা অনাদায়ী রয়েছে। সঠিকভাবে বিল করা হলে এই বিল কয়েকগুণ বেশি হওয়ার কথা। আবুল খায়ের গ্রুপের এই গ্যাস চুরির বিষয়টি গ্যাস কোম্পানি কেজিডিসিএল’র অনেকেই অবগত ছিলেন। কিন্তু তারা অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে বিষয়টি চেপে গেছেন। এমনকি ন্যূনতম বকেয়ার টাকাও আদায়ে উদ্যোগি হননি বলে দুদকের তদন্তে বলা হয়েছে।
আবুল খায়ের স্টিলের জালিয়াতি এবং গ্যাস চুরির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। কোম্পানিটি এতোটাই প্রভাবশালী যারা দুর্নীতি ধরার চেষ্টা করেছিলেন তারাই অনেকে চাকরি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। ওই পুকুরি চুরির এতো এতো প্রমাণ পাওয়ার পরও না একেএস (আবুল খায়ের স্টিল) না কেজিডিসিএল’র (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড) কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে! বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে কেজিডিসিএল’র কোম্পানি সচিব ফিরোজ খান, মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমানসহ সাঙ্গপাঙ্গরা। আর যথারীতি সংযোগটিও সক্রিয় রয়েছে এখন পর্যন্ত। নজির বিহীন জালিয়াতির মাধ্যমে পাওয়া ওই সংযোটি নিয়ে কেউই মুখ খুলতে রাজি না। কথিত রয়েছে প্রভাবশালী ওই কোম্পানিটি লাইন পেতে জলের পানির মতো টাকা ঢেলেছেন। যে কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া এবং উপদেষ্টার অনুমোদন বিহীন লোড বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রহস্যজনক কারণে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রায় সকলেই ঠোঁট চেপে বসে আছেন, যেনো কিছুই ঘটেনি, যা ঘটেছে সবই নিয়মের মধ্যেই হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য একাধিকবার ফোন দিলেও ফোন রিসিভ করেন নি কোম্পানি সচিব ফিরোজ খান, এসএম দিলেও সাড়া দেন নি। মহাব্যবস্থাপক আমিনুর রহমান ফোন রিসিভ করলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
কেজিডিসিএল’র একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, প্রায় ১২ কোটি টাকা বকেয়ার তথ্য গোপন করে শ্রেণি পরিবর্তনের নামে লোড দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়েছে। সংযোগটি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো রকম নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। আবার তারা আগে থেকেই বেশি গ্যাস ব্যবহার করতো, সবকিছু জানার পরও কর্তারা নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। এক কর্মকর্তা যায় আরেকজন আসে কিন্তু এসব দুর্নীতি বন্ধ হয় না। এর পেছনে কারণ হচ্ছে এসব অবৈধ সংযোগ থেকে মাসোহারা পেয়ে আসছে কর্তারা। তাই সবকিছু জেনেও চোখ বন্ধ থাকেন তারা।
আবুল খায়ের স্টিল লিমিটেডের (একেএস) বিরুদ্ধে গ্যাস জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। কোম্পানিটি ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকার বকেয়া বিলের তথ্য গোপন করে অবৈধভাবে ৩টি সংযোগে লোড দ্বিগুণ করে নিয়েছেন। শুধু বকেয়ার তথ্য গোপন নয়, ক্যাপটিভ পাওয়ারে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক হলেও এগুলো ছাড়াই সংযোগ পাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
আবার ফাইল অনুমোদন হওয়ার দুই দিন আগেই সংযোগ পেয়ে জালিয়াতির রেকর্ড গড়েছে আলোচিত ওই কোম্পানিটি। কেজিডিসিএল (কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লি) নিয়মনীতি উপেক্ষা করে গ্যাসের লোড বাড়িয়ে দিয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে উঠে এসেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম দুদকে ওই প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন একজন সহকারি পরিচালক। তদন্ত রিপোর্টে আবুল খায়ের গ্রুপের পরিচালক (ডিএমডি) আবু সাঈদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সুপারিশ করা হয়েছে। ওই তদন্ত রিপোর্ট জমা হওয়ার পর থেকেই ধামাচাপা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে আবুল খায়ের গ্রুপ।
সূত্র জানায়, একেএস’র সীতাকুন্ডের শীতলপুর কারখানায়(শিল্প খাত কোড নং- ৬৩১১, ক্যাপটিভ পাওয়ার খাত কোড নং-৬৩১১) গ্যাস সংযোগ বিদ্যমান। চালনা ধাঁচ পরিবর্তনের আড়ালে অত্যন্ত সুকৌশল ও পরিকল্পিতভাবে বর্ণিত গ্রাহককে দুই গুণ লোড লোড বৃদ্ধি করে দেন কেজিডিসিএল। যখন গ্যাসের লোডটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন কোনো বিতরণ কোম্পানির হাতে এই ক্ষমতা ছিল না। গ্যাস সংযোগ প্রদান কিংবা লোড বাড়িয়ে দিতে হলে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির পূর্বানুমোদন আবশ্যক ছিল। কিন্তু একেএস’র সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে ওই কমিটির কোনো পূর্বানুমোদন নেওয়া হয় নি।
কোম্পানিটির সীতাকুন্ডের শীতলপুরে অবস্থিত আবুল খায়ের স্টিল লিমিটেড’র (গ্রাহক সংকেত শিল্প-৬৩১১) অনুমোদিত লোড ২১ লাখ ১৬ হাজার ২৯৬ ঘনমিটার থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ, একই ঠিকানায় থাকা ক্যাপটিভ পাওয়ারে (গ্রাহক সংকেত শিল্প-৬৩১১) ২১ লাখ ৬২ হাজার ৯৭২ ঘন মিটার থেকে বাড়িয়ে লোড দ্বিগুণ করে দেওয়া হয়। মাদামবিবিরহাটে অবস্থিতি আবুল খায়ের লিমিটেড (গ্রাহক সংকেত শিল্প ৬২৪১) ৩ লাখ ৭১ হাজার ৬০৪ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। দুদকের তদন্তে চালনা ধাঁচ পরিবর্তনের আড়ালে আরও একটি মহাদুর্নীতির প্রমাণ উঠে আসে।