রাবি: নিয়োগ তালিকায় ছাত্রলীগ, শিক্ষকের স্বজন ও সাংবাদিক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়াদ শেষে যাবার আগে উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক আবদুস সোবহান যে শতাধিক অস্থায়ী নিয়োগে সই করেছেন, সেই তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তান-স্ত্রী-স্বজন, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে একাধিক সাংবাদিক নেতাও রয়েছেন। বুধবার (৫ মে) নিয়োগের জন্য প্রস্তুতকৃত ভিসির সই করা কাগজগুলো বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বৃহস্পতিবার (৬ মে) ছিল ভিসির শেষ কর্মদিবস। এ দিনই তিনি ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন। এরপরই নিয়োগের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। তবে নিয়োগ হতে পারে, এমন গুঞ্জন সপ্তাহ ধরেই ছিল। এর পক্ষে-বিপক্ষে সংঘর্ষও হয়েছে। বৃহস্পতিবারও দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে ক্যাম্পাসে।
তারপরও ভিসি অন্তত ১৪১ জনের চাকরি নিশ্চিত করে গেছেন। যদিও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই নিয়োগকে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত হিসেবে উল্লেখ করে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
তালিকা-অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিবারের ৩ জন সদস্য শিক্ষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। যে বিভাগগুলোতে নিয়োগ দেখানো হয়েছে, শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি জানে না সেই বিভাগের প্লানিং কমিটিও। এর বাইরে কর্মকর্তা পদেও নিয়োগ পেয়েছেন একাধিক শিক্ষকের স্বজন।
শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগের খন্দকার ফরহাদ হোসেনের ছেলে ঋত্বিক মাহমুদ। যিনি সংগীত বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ তালিকায় ৫ নম্বরে নাম তার। খন্দকার ফরহাদ হোসেন লেখালেখির জগতে অনীক মাহমুদ নামে পরিচিত।
বিভাগীয় প্লানিং কমিটি থেকে ঋত্বিক মাহমুদের নিয়োগের সুপারিশ গেছে কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে সঙ্গীত বিভাগের প্লানিং কমিটির সদস্য পদ্মীনি দে বলেন, নিয়োগ নিয়ে বিভাগীয় প্লানিং কমিটির কোনো সভা হয়নি। কীভাবে নিয়োগ দিয়ে গেছেন উপাচার্য সেইটা সবাই জানেন।
ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. চিত্তরঞ্জন মিশ্র-এর ছেলে ইন্দ্রানিল মিশ্র। নিয়োগ তালিকার ৩ নম্বরে আছে তার নাম। এছাড়া দুই শিক্ষকের স্ত্রী নিয়োগ পেয়েছেন আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব এক্সেলেন্স ইন টিচিং অ্যান্ড লার্নিং-এর সহযোগী অধ্যাপক (আইটি) হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. খাইরুল ইসলামের স্ত্রী ড. সাবিহা ইয়াসমিনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সিন্ডিকেট সদস্য এবং প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ বলেন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিভাগীয় প্লানিং কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ দরকার হয়। তবে তাদেরকে নিয়োগে বিভাগগুলোর প্লানিং কমিটির কোনো সুপারিশ নেওয়া হয়নি। তাই এই নিয়োগ অবৈধভাবে ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়েছে।
কলেজ পরিদর্শক ও অধ্যাপক ড. আব্দুল গণি এর স্ত্রী ফারহানা একরাম নিয়োগ পেয়েছেন তাপসী রাবেয়া হলের আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে। সহকারী আবাসিক শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন রিয়াজির স্ত্রী বুরুজ ই জোবাইরা।
শেষ সময়ের এই নিয়োগে অধ্যাপক আবদুস সোবহান বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জন সাংবাদিকের নিয়োগপত্রেও সই করেছেন। তাদের মধ্যে দুজন সাংবাদিক নেতা। রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়নের (আরইউজে) নির্বাহী সদস্য আনিসুজ্জামানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের সহকারী রেজিস্ট্রার পদে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি, রাজশাহী মেট্রোপলিটন প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) প্রাক্তন নির্বাহী সদস্য। বর্তমানে তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে রাজশাহীতে কর্মরত।
বৃহস্পতিবার ভিসির সইয়ে নিয়োগ পেয়ে কাজে যোগ দিয়েছেন মেহেদী হাসান শ্যামল নামের আরেক সাংবাদিক নেতা। তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের সেকশন অফিসার হিসেবে। তিনি রাজশাহী টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আরটিজেএ) সভাপতি। কাজ করেন মোহনা টেলিভিশনে।
সেকশন অফিসার হিসেবে আরও নিয়োগ পেয়েছেন সাংবাদিক এনায়েত করিম ও আমজাদ হোসেন শিমুল। এনায়েত করিম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (রাবিসাস) সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি উত্তরা প্রতিদিন নামের একটি স্থানীয় দৈনিকে কাজ করেন। আমজাদ হোসেন শিমুল রাবিসাস-এর সাবেক সহসভাপতি। বর্তমানে তিনি রাজশাহীতে দৈনিক আমাদের সময়ে কাজ করেন।
এর বাইরে অন্তত ২০ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর নাম এই নিয়োগ তালিকায় রয়েছে। যারা পরিচিত মুখ চাকরি পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইলিয়াস হোসেন, আতিকুর রহমান তমাল, সাবেক ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক টগর মোঃ সালেহ, বর্তমান সহ-সভাপতি মাহফুজ আলামিন, সুরন্জিত প্রসাদ দীপ্ত, ফারুক হোসেন,ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম রেজা, ফিরোজ ও ডিল।
এদের নিয়োগের তালিকায় তার নিজের সই আছে। এর বাইরে আর একটি আইনও মানেননি সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহান। সিন্ডিকেট বৈঠক বসেনি, রেজিস্ট্রারও সই করেননি, তারপরেও একরকম গায়ের জোরেই বিদায় বেলায় শতাধিক নিয়োগ দিয়ে গেছেন তিনি।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. মো. হাবীবুর রহমান বলেন, নিয়ম অনুসারে এই নিয়োগে সিন্ডিকেটের অনুমোদন দরকার। কিন্তু সেই বৈঠক হয়নি। স্থগিত করা বৈঠক ডাকতে হলেও তো সময় দরকার। সেই সময় তো তিনি (ভিসি) পাননি। তাহলে কীভাবে এই নিয়োগ বৈধ হয়?
এদিকে এই নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারও সই করেননি। প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, ভিসি নিয়োগে সই করতে বললেও রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম তাতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এরপর রাতারাতি ভিসি আবদুস সোবহান একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে দিয়ে নিয়োগ সই করিয়ে নেন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (৬মে) সন্ধ্যায়ই এই নিয়োগকে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূত বলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। বিষয়টি নিয়ে ভিসি অধ্যাপক আবদুস সোবহানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার (৬মে)ক্যাম্পাসের বাসা ছাড়ার পর তিনি রাবি সংলগ্ন চৌদ্দপাই এলাকায় শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয় হাউজিং সোসাইটির (বিহাস) বাসায় উঠেছেন। বিহাসের প্রবেশের মূল ফটকে পুলিশের পাহারা বসানো হয়েছে। অপরিচিত কাউকে সেখানে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কোনভাবেই বিদায়ী ভিসির সঙ্গে কথা বলা যায়নি।