'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে'
গানের কথা ও সুর প্রজন্ম পেরিয়ে মানুষের মনে মনে দোলা দেয়: 'তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে/রাতের বাসরে দোসর হয়ে তাই সে আমারে টানে/রাতের আকাশে তারার মিতালী আমারে দিয়েছে সুরের গীতালী/কত যে আশায় তোমারে আমি জ্বালিয়ে আমি রেখেছি দ্বীপালী/আকুল ভ্রমরা বলে সে কথা বকুলের কানে কানে।'
অথচ জনপ্রিয় গানটি যিনি গেয়েছেন, তিনি বাংলাভাষী নন। কে জি মোস্তফা রচিত এই গানের মতো অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গান, নজরুল সঙ্গীত গেয়েছেন তিনি। বাংলা গানের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় জনপ্রিয় শিল্পী তালাত মাহমুদকে উপমহাদেশের গানের জগতের শ্রেষ্ঠতম তিনজনের একজন রূপে গণ্য করা হয়। তিনি ভারতীয় সঙ্গীতাঙ্গনের 'তিন পুরুষের গায়ক' নামে পরিচিত তিন নক্ষত্রের একজন। অন্য দুজন হলেন মোহাম্মদ রফি এবং মুকেশ, যারা চলচ্চিত্রের গানে কয়েক প্রজন্ম ধরে শিখরস্পর্শী জনপ্রিয়তার রেকর্ডের অধিকারী।
তালাত মাহমুদকে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা পুরুষ 'অ-শাস্ত্রীয়' ও 'অর্ধ-শাস্ত্রীয়' গায়করূপে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তিনি ছিলেন একজন সংগীতশিল্পী, যার ছিল সহজাত প্রতিভা, অনুপম সৌন্দর্যচেতনা ও মাধুর্য। একজন প্লে-ব্যাক কণ্ঠশিল্পী হলেও তিনি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেন, যদিও অভিনয়ে তিনি সফলতা পাননি।
২৪ ফেব্রুয়ারি নিভৃতে চলে গেলো তালাত মাহমুদের জন্মদিন। ১৯২৪ সালের এ দিনে উত্তর ভারতের ঐতিহ্যবাহী লখনৌ শহরের এক উর্দুভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশবেই তিনি সংগীতের প্রতি তার অভিনিবেশ প্রদর্শন করেন। সমস্ত রাত জেগে তিনি নিবিষ্ট চিত্তে তৎকালীন বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় গায়কদের গান শ্রবণ করতেন। তিনি ছিলেন এমন এক রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান যেখানে সংগীত চর্চাকে উৎসাহিত করা হত না। চলচ্চিত্রে কাজ করবেন ও না বাড়িতে অবস্থান করবেন এর মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। পিতার আপত্তি সত্ত্বেও তিনি চলচ্চিত্রকেই বেছে নেন। তবে চলচ্চিত্র শিল্পে সম্মানজনক অবস্থান অর্জন করলে এক যুগ পর তার পরিবার বিষয়টিকে মেনে নেয়।
১৯৩০-এর দশকের শেষদিকে লখনৌর মারিস সংগীত মহাবিদ্যালয় (বর্তমান ভাতখাঁড়ে সংগীত ইন্সটিটিউট) পণ্ডিত এস.সি.আর. ভাটের নিকট ধ্রুপদী সংগীতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৩৯ সালে গজল গায়করূপে সংগীত জীবন শুরু করেন। ১৯৩৯ সালে ষোল বছর বয়সে অল ইন্ডয়া রেডিও, লখনৌ-এ দাগ, মির, জিগর গজল গেয়ে তার সংগীতজীবনের সূচনা । তার কণ্ঠস্বর অন্য গায়কদের চেয়ে স্বতন্ত্র প্রকৃতির ছিল। তার এই স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করে এইচএমভি গ্রুপ ১৯৪১ সালে গানের ডিস্ক বের করার প্রস্তাব দেয়, যাতে ছিল ‘সব দিন সামান নেহি থা’, ‘বান জাঁও গিয়া কিয়া সে কিয়া মেঁ’, ‘ইস্কা তো কুচ ধিয়ান নেহিঁ থা’-র মতো গান।
গজল গায়ক হিসেবে তার সুখ্যাতি লখনৌ ছাড়িয়ে কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছে যেটি তার গন্তব্য হয়ে যায়। তখন কলকাতায় ছিলেন বিখ্যাত গজল গায়ক ও সংগীতজ্ঞ উস্তাদ বরকত আলি খান, কে. এল. সাইগল ও এম এ রউফের মতো ব্যক্তি। ১৯৪৪ সালে তার গানের ডিস্ক সর্বাধিক বিক্রীত হিসেবে জায়গা করে নেয়। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে। তিনি কলকাতা ও বোম্বের ১৬টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এর মধ্যে তিনটি চলচ্চিত্র সাফল্য পায়। প্রথম দিকে তিনি ‘তপন কুমার’ নামে অনেক বাংলা গান পরিবেশন করেন। তার গাওয়া কিছু বাংলা গান ছিল সুপার হিট এবং এখনো বেতারে বাজে। তিনি ’৫০ ও ’৬০-্এর দশকে অনেত বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের সুরে গান করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন--কমল দাশগুপ্ত (দুটি পাখি দুটি তীরে), সুধীন দাশগুপ্ত (এই রিমঝিমঝিম বরষা), রবিন চট্টোপাধ্যায় (চাঁদের এত আলো), হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (এ যদি আকাশ হয়) এবং ভি এল বালসারা (তুমি সুন্দর যদি নাহি হও)।
১৯৪৯ সালে হিন্দি চলচ্চিত্রে গান করার জন্যে তালাত মাহমুদ বোম্বে চলে যান। আগে থেকেই তার খ্যাতি ছিল ছিল ছড়ানো, বোম্বে যাবার সাথে সাথে অনেক কাজের প্রস্তাব আসতে থাকল। ‘আরজু’ ছায়াছবিতে অনিল বিশ্বাসের পরিচালনায় তার গাওয়া ‘এই দিল মুঝে এইছি জাগা লে চল জাঁ কোয়ি না হো’ গানটি তাকে বিশাল সফলতা এনে দেয়। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৯২ সালে চলচ্চিত্রে তার সুরের অপূর্ব ব্যবহার ও গজলে সবিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত হন। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তার গানগুলোয় উচ্চ সাহিত্যিক কথকতার প্রয়োগ ছিল ও শিল্প সমজদার ভারত উপমহাদেশে বিশেষতঃ উর্দুভাষী সম্প্রদায়ে তার বেশ কদর ছিল। এমনকি তার বাতিলকৃত গানগুলোও জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়। ঐ সময়ে অন্য কোন গায়ক তার ন্যায় উচ্চশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তি ও শিক্ষিতমানের ছিলেন না।
সুদীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে প্রায় আটশত গান গেয়েছেন তিনি। তালাত মাহমুদ আধুনিক অর্ধ-শাস্ত্রীয় ও শাস্ত্রীয়বিহীন গজলের প্রকৃত রচয়িতা ছিলেন। ফলে, সমসাময়িক অন্যান্য গজল গায়কদের উপর তার বেশ প্রভাব পড়ে। এর ফলে মেহেদী হাসান ও জগজিৎ সিংয়ের অগ্রগণ্য রূপে তাকে ধরা হয় সহজাত প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিল তার গজলের মধ্যে। পঙ্কজ উদাস তাকে সর্বদাই 'শাহানশাহ-ই-গজল' উপাধিতে সম্বোধন করতেন।
১৯৫৬ সালে পূর্ব আফ্রিকায় প্রথম ভারতীয় গায়ক হিসেবে বিদেশে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ভ্রমণ করেছিলেন। এরপর বেশ কিছু দেশে যান। ১৯৯৮ সালের ৯ মে ৭৪ বছর বয়সে বোম্বেতে পরলোক গমন করেন তালাতমাহমুদ।