আবার জন্মালেও মেয়ে, না হয় মেয়েলি পুরুষ হতে চাই: সায়ান

  • মাসিদ রণ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো নন্দিত সঙ্গীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ানের একক সঙ্গীত সন্ধ্যা। ‘গানে গানে সায়ান’ নামে প্রায় আড়াই ঘণ্টার পরিবেশনায় সায়ানকে একবারের জন্যও চাইতে হলো না হাততালি, অনুরোধ করতে হলো না শান্ত থাকতে! দর্শক স্বতঃস্ফূর্তভাবেই প্রতিটি গান শেষে হলরুম ভরিয়ে দেন ভালোবাসাসমেত তালিতে আবার গান শুরু করতেই পিনপতন নীরবতা বজায় রাখেন। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা হলো, যারা সেই অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছেন তারাই কেবল জানেন এই আত্মতৃপ্তির কথা।

অনুষ্ঠান শেষে সায়ানকে এভাবেই ঘিরে ধরে ভক্তরা । ছবি: নূর এ আলম

একেই বলে আক্ষরিক অর্থে একক পরিবেশনা। তিনি শুধু একা গাইলেনই না, মাত্র তিনটি বাদ্যযন্ত্র একা বাজিয়েই শেষ করলেন পুরো শো।

জুলাই বিল্পবে সায়ান নতুন করে আলোচনায় আসেন। কারণ তার গানের কথা ও সুর বরাবরই সমাজিক নিপীড়নের কথা বলে, রাজনৈতিক অপক্ষমতার বিরুদ্ধাচরন করে।

বিজ্ঞাপন
ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

সায়ানের একক গানের অনুষ্ঠানে গিয়ে অবাক না হয়ে উপায় ছিলো না। কারণ তাকে শুনতে যেমন এসেছে জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা, তেমনি এসেছেন সত্তরোর্ধ নারী-পুরুষ। শুধু তাই নয়, সায়ান যে প্রেম, ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতিও এতো জোরালোভাবে তার গানে উপস্থাপন করেন তাও নতুন করে জানা গেলো।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

সায়ান সেদিন অনুষ্ঠান শুরু করেন কিছু কথা দিয়ে। তিনি জানান, তিন শ্রেণির মানুষকে তিনি ঘৃণা করেন। প্রথমত, যারা প্রকাশ্যে বা মনে মনে মানুষকে খাটো করে; দ্বিতীয়ত, যারা ধর্ষক কিংবা জীবনের যে কোন পর্যায়ে যৌন হেনস্তা করেছে এবং যারা যৌন হেনস্তা করতে দেখেও তার প্রতিবাদ করেনি; তৃতীয়ত, যারা মনে করেন যে একটি দেশে একটিই মাত্র দল থাকবে অর্থাৎ বহুত্ববাদকে যারা খারিজ করতে চায় তাদের।

বিজ্ঞাপন
ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

অনুষ্ঠান ছিলো দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথম সেশনে সায়ান তার চিরাচরিত প্রতিবাদের গানগুলো শোনান প্রায় ঘন্টা দেড়েক সময় ধরে। এরপর আরও পৌঁনে এক ঘণ্টা ছিলো তার গানে গানে প্রেমময় সত্তা’র প্রকাশ।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

প্রথমেই গেয়ে ওঠেন ‘আমি মুসলমানের মেয়ে’ গানটি। এরপর সায়ান তার আশেপাশের সকল নারী এবং বিশ্বের তাবৎ নারীশক্তিকে উৎসর্গ করে গাইলেন ‘এই মেয়ে শোন’।

দর্শক সারিতে জনপ্রিয় অভিনেত্রী শানারেই দেবী শানু ও আইরিন সুলতানা। ছবি: নূর এ আলম

অনুষ্ঠানের এই পর্যায়ে সায়ানের গানের কথা, সুর আর গায়কীতে দর্শক বুদ হয়ে পড়েছেন। সায়ান এবার আর গাইলেন না। একটু কথা বলে উঠলেন। জানালেন একটি মজার কথা। তাকে নাকি অনেক মানুষ জিজ্ঞেস করে, তিনি ছেলে নাকি মেয়ে? তাদের উত্তর দিয়ে সায়ান বলেন, ‘আমি শতভাগ মেয়ে। যদি আবার জন্ম হয় যেন মেয়ে হয়েই জন্মাই। আর যদি তা না হয়, যেন মেয়েলি পুরুষ হয়ে জন্মাই! আমি আসলে পুরুষের বিপক্ষে নই, কিন্তু ব্যাটাগীরীর বিপক্ষে। ব্যাটাগীরী নিপাত যাক।’

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

এরপর সায়ান একে একে গেয়ে শোনান সমাজের বিভিন্ন আলোচিত হত্যাকাণ্ড নিয়ে গান। তারমধ্যে একটি পাহাড়ি মেয়ে কল্পনা চাকমাকে নিয়ে লেখা। যে মেয়েটি শক্তি আর ক্ষমতাকে ভয় না করে পাহাড়ি মানুষের অধিকারের কথা বলেছিলো। একদিন তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে আর কোনদিন ফিরে আসেনি, জীবিত অথবা মৃত। বেঁচে থাকলে সায়ানের বয়সীই হতেন, সেটিও জানালেন শিল্পী।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

এরপর তিনি গেয়ে ওঠেন গার্মেন্টসকর্মী চম্পা খাতুনের গান। যে তার ন্যায্য পারিশ্রমিক চেয়ে পায়নি, তাকে পিটিয়ে মারা হয়।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

সায়ান গাইতে ভোলেননি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নিয়েও। তিনি বলেন, ‘‘আবরারকে মেরে হত্যাকারীরা রাস্তায় মিছিল দিয়েছিলো, ‘জয় বাংলা!’’ তাইতো তিনি বলেন, ‘স্লোগানের পবিত্রতা কথায় নয়, তার উদ্দেশ্যে থাকে।’

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

এরপর সায়ান গানে গানে শোনান ফিলিস্তিনির মানুষের শক্তি, স্বাধীনতার আহাজারি ও তাদের ওপর দমন-পীড়নের কথা। ‘আমি প্যালেস্টাইন’ নামের এই গানের মাধ্যমে সায়ান ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন।

গাইছেন সায়ান, মুগ্ধ হয়ে শুনছে দর্শক । ছবি: নূর এ আলম

এরপর ‘স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি’, ‘নষ্ট মুক্তিযোদ্ধা’, ‘রানীমা’, ‘মাটির সঙ্গে গাদ্দারি’, ‘এইবার কি যেন হবে, মন চায় নির্বাসনে যাই’, গানগুলোতে উঠে আসে নিকট অতীতে বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, ক্ষমতা নিয়ে তার উপলব্ধির কথা।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

প্রতিবাদী গানের সেশন শেষ করেন নিজের রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করেন। সায়ানের ভাষ্য, ‘‘আমি নিরপেক্ষ নই। গা বাঁচিয়ে চলি না। আগে মাটির পক্ষে ছিলাম। জুলাই আন্দোলনে একটা পক্ষ নিয়েছিলাম প্রকাশ্যে। এই পুরো শো’টি আমি জুলাই বিল্পবের নামে উৎসর্গ করলাম।’’

গান শুনিয়ে আনন্দিত সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

১৫ মিনিটের চা পান বিরতির পর শুরু হয় ‘গানে গানে সায়ান’-এর দ্বিতীয় সেশন। এই সেশনে তিনি গাইলেন প্রেমের গান, বিরহের গান, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের গান, সর্বপরি মানুষের প্রেমময় আবেগ-অনুভূতির গান।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

প্রথম গানটিতে ছিলো দীর্ঘ সম্পর্কে থাকতে থাকতে জমে ওঠা তিক্ততা, একঘেয়ামি কিংবা অভিমান ভুলে আবার এক হওয়ার বার্তা। ‘দুজনে সব ভুলে যাই’-এর পর সায়ান গাইলেন ‘এইখানে সুখ ছিলো একদিন’। গানটির কথা ও সুর এতোটাই হৃদয়গ্রাহী যে, সত্তরোর্ধ দর্শকের চোখও তখন ছলছল। সবাই গানটির সঙ্গে নিজের আবেগকে মিলিয়েমিলিয়ে ফেলেছে তখন।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

পরিবেশ হালকা করতে সায়ান বললেন, ‘প্রেম হলো দো-ধারী তলোয়ার। প্রেমে পড়লেও কাটে, না পড়লেও কাটে।’ কথাটি শুনে দর্শক আবার হেসে কুটিকুটি। এই পরিবেশে সায়ান ধরেন তার পরের গান ‘ভাসিয়ে দেবো তোরে ও আমার প্রাণের বন্ধু ওরে’।

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

প্রেম প্রেম গন্ধ যখন অনুষ্ঠানস্থলে, সায়ান তখনই তার পরের গানে দেখালেন প্রেমের ভিন্ন রূপ! ‘লাটাই’ গানটিতে তিনি তুলে ধরলেন সেই সম্পর্কের গল্প যাতে একজন সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে। যেন অন্যজন তার হাতের ঘুড়ি, লাটাই যেভাবে নাড়াবে সেভাবেই সে উড়তে বাধ্য!

ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান । ছবি: নূর এ আলম

শেষ গান ধরবেন, কিন্তু দর্শকের একের পর এক অনুরোধ আরও হাফ ডজন খানেক গানের। সব অনুরোধ শিল্পী রাখতে পারলেন না ঠিকই, কিন্তু কথা দিলেন পরের কোন অনুষ্ঠানে সেই গানগুলো শুনিয়ে দেবেন। এরপর দর্শকের অনুরোধ থেকেই একটা অতিরিক্ত গান ‘কিছুতো একটা তুমি বলো’। এই গানে প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রেয়সীর কাছে আকুতি করে একটা কিছু বলার। সম্পর্কের মধ্যে কথা ফুরিয়ে গেলে তা কতোটা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে সেটা বোঝা যায় এই গানে। এজন্য সম্পর্কের পরিচর্যা করা খুবই জরুরী।

সায়ান যখন গাইছেন, আক্ষরিক অর্থেই দর্শক নীরব । ছবি: নূর এ আলম

অনুষ্ঠানের শেষ গান হিসেবে তিনি আগেই ঠিক করে রেখেছেন তার বহুল জনিপ্রয় গান ‘এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধু’কে। সেটিই গাইলেন, তার অনবদ্য গায়কীর সাথে সাথে দর্শক হারিয়ে গেলো ছেলেবেলার নস্টালজিয়ায়। আবার তার গানের সাথে সাথেই ফিরে এলো বর্তমানে। মনে পড়ে গেলো সেই সব প্রিয় বন্ধুদের, যারা একটা সময় আমাদের হৃদয় জুড়ে ছিলো, জীবন জুড়ে ছিলো। সত্যিই তো, কোন শত্রুরও যেন প্রাণের বন্ধু দূরে সরে না যায়!