কোভিড নিয়ে মুখোমুখি সমকালীন বুদ্ধিজীবী (শেষ পর্ব)
মহামারিতে বেড়েই চলছে মৃত্যুর মিছিল। চীনের উহান থেকে যে যাত্রার শুরু হয়েছিল, তা এশিয়া ও ইউরোপকে ছাপিয়ে ল্যাটিন আমেরিকাকেও নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। ঠিক এই সময়ে করোনার প্রভাব এবং পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন সমকালের বুদ্ধিজীবীরা। আজ থাকছে শেষ কিস্তি।
কোভিড নিয়ে মুখোমুখি সমকালীন বুদ্ধিজীবী (১ম পর্ব)
কোভিড নিয়ে মুখোমুখি সমকালীন বুদ্ধিজীবী (২য় পর্ব)
প্যারিস: কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে আমরা জাতীয় স্থিতিস্থাপকতার পুনর্মূল্যায়ন এবং কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনকেই দেখতে পাচ্ছি। এটি বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনের পুনর্গঠন করবে, নতুন করে গড়ে তুলবে বাফার এবং মজুদ রাষ্ট্র। অবশ্য নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। সংরক্ষণবাদকে ছাপিয়ে গিয়ে মানুষ সম্ভাব্য ঝুঁকিকেই বেছে নেবে। মানুষের সাথে আরো বেশি জড়িয়ে পড়বে গিগ ইকোনমি। বিশেষ করে স্বাস্থ্যখাতে।
জাতীরাষ্ট্রগুলো আলাদা হয়ে পড়বে। জাতি একটা কনক্রিট ধারণা। যেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা অপেক্ষাকৃত নমনীয়।
লন্ডন: এটাই বিশ্বায়নের সমাপ্তিপর্বের সূচনা। অন্তত যেভাবে আমরা জানি। গত শতকগুলোতে আদর্শগত ও চর্চা হিসাবে যে বৈশ্বিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল; এর মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটবে। এটা একটা প্যারাডক্সের মতো। বৈশ্বিক সমস্যা বৃদ্ধির দরুন যে সময়ে বৈশ্বিক সংহতি ও সহযোগিতা বেশি জরুরি; আমরা তখনই দেখতে পাচ্ছি বিপরীতমুখী জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রসার।
এই সময় আঞ্চলিকতাবাদের প্রসারের আশাও করা যায়। বিভিন্ন দেশ হাজার রকম সমস্যা নিয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করার জন্য আঞ্চলিক ব্লক তৈরি করবে। একই সাথে কিছু মানুষ থাকবে আন্তর্জাতিকতাবাদের হয়ে কথা বলতে। অবশ্যই গত শতকের অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন না; বরং নতুন বিষয় নিয়ে নতুন ধারার আন্তর্জাতিকতা। স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের মতো ইস্যুগুলো সেখানে প্রাধান্য পেতে পারে। অন্যথায় এই মহামারি হবে জাতীয়তাবাদের উত্থানের সুবর্ণ সুযোগ।
নব্বইয়ের দশকের আশাবাদ অনেক আগেই ম্লান হয়ে গেছে। আমরা এখন হতাশার যুগে প্রবেশ করেছি। কোনো কিছুকেই নিখাঁদ মনে হয় না। মৌল প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশ্বাস হ্রাসের প্রতিক্রিয়া আমরা এতক্ষণে দেখতে শুরু করেছি। এক সময় ইউরোপ জুড়ে পপুলিস্ট নেতারা চুপ মেরে ছিল। এতে মনে হতে পারে তাদের দিন শেষ। কিন্তু আসল ঘটনা তা না। মহামারির মধ্যে বা শেষেই সমাজ ও অর্থনীতিতে মৌলিক আঘাতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। আর তা পপুলিস্ট নেতাদের উর্বর পাটতন দেবে।
নার্স, এম্বুলেন্সের ড্রাইভার, সুপার মার্কেটের কর্মচারী কিংবা সরবরাহকারীদের কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ; আমরা দেখতেই পাচ্ছি। ব্রেক্সিটের সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভিবাসীদের নানাভাবে অবজ্ঞা করা হতো। বর্তমানে তাদের কঠোর পরিশ্রম ও অবদানের জন্য প্রশংসা করা হচ্ছে। শ্রমিকদের সাথে ‘স্বল্পদক্ষ’ কিংবা ‘অদক্ষ’ পরিভাষাগুলো ব্যবহারের আগে রাজনীতিবিদদের দ্বিতীয়বার ভেবে দেখা উচিত।
বিভিন্ন ধরনের একনায়কতন্ত্র জেগে ওঠার দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। ইউরোপ জুড়ে হাঙ্গেরি বর্তমানে একনায়ক দেশ। প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিপক্ষকে নিশ্চুপ রাখার জন্য মহামারিকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করছেন। কেন্দ্র আর পরিধির এই ভারসাম্য হারানোয় পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বেগ পেতে হবে। মনে রাখতে হবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কথা।
তুরস্কে রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এই জটিলতা থেকে সুবিধা নিতে চান। নিজের একনায়ক অবস্থানকে পোক্ত করতে তিনি শরণার্থী প্রবেশ করাতেও দ্বিধা করবেন না। চীন, আধা-একনায়ক সিঙ্গাপুর এবং ভারত—প্রত্যেকেই আমাদের সামনে দাঁড় করিয়েছে ব্যক্তির স্বাধীনতা বনাম রাষ্ট্রের জবরদস্তি- এই সংঘাতের সামনে। এখন আমাদের সকলকেই হতে হবে মানবিক অধিকারের রক্ষক।
ক্যামব্রিজ: বিশ্বের বড় দুই অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীন মহামারিতে সাড়া দিয়েছে দ্রুত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সংস্থার দিকে মনোযোগ দেবার সময় পায়নি। প্রতিযোগিতামূলক প্রোপাগান্ডার বাইরে এসে নেতাদের কাজ করা উচিত। কাজ করা উচিৎ ‘কারো উপরে’ না; বরং ‘কারো সাথে’ কে আদর্শ ধরে। পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দ্বিপাক্ষিক কিংবা বহুপাক্ষিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। নিজের এবং মানবতার স্বার্থে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে জাতিসংঘের কোভিড-১৯ তহবিলে অবদান রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ।
এই পথ অনুসরণ করলে কোভিড-১৯ একটা বসবাসযোগ্য পৃথিবীর দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু যদি বর্তমানে যেদিকে হাঁটছি সেদিকেই সেভাবে হাঁটতে থাকি, ভাইরাস শীঘ্রই পপুলিজমের উত্থান এবং প্রযুক্তির একনায়কতন্ত্রিক ব্যবহারের সুযোগ করে দেবে। খুব সম্ভবত এখনো বেশি দেরি হয়ে যায়নি। কিন্তু সময় থেমে নেই।
লস এঞ্জেলস্: জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক এবং চিকিৎসক আলবার্ট শুয়েইটজার একবার বলেছিলেন, ‘মানুষ আগে থেকে দেখা কিংবা কাজ করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে; তার সমাপ্তিটা হবে পৃথিবীকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে।’
আমাদের সতর্ক করা হচ্ছিল যে, আমরা গ্রহের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যাচ্ছি; যা আমাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে দেখা দেবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং গ্রিনল্যান্ড ও তুন্দ্রা অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ার ফলাফল হিসাবেই আমরা হারাব আমাজনের মতো বনাঞ্চল। বর্তমান মহামারির পেছনে আমাদের দায় নেহায়েত কম না।
অর্থনীতি এবং জীবন মান আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়াটা চ্যালেঞ্জিং হবে। যদি সম্ভবও হয়, তাহলেও আমাদের যাত্রা আরো বড় ধরনের মহামারির মুখোমুখি করবে। বস্তুত আমাদের যাপিত জীবন যেন পৃথিবীর ওপর বাজে প্রভাব না ফেলে; সেই দিকটা রাতারাতি নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। গ্রহের সম্পদ ভোগ যেন পরিমাণে কম এবং দীর্ঘমেয়াদী পন্থায় হয়। বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগের মতো বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমেই কেবল আমরা পরিবেশ এবং অর্থনীতির অবক্ষয়কে প্রতিরোধ করতে পারি। এসময় অপেক্ষার না; সঠিক এবং উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের। স্বাভাবিকতায় ফিরে যাবার জন্য।
হংকং: মহামারিতে বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া স্টেকহোল্ডারের মতো। সরকার তার সিদ্ধান্ত এবং সতর্কতামূলক বিবৃতি প্রকাশ করে দিচ্ছে। জনগণের প্রত্যাশার দিকেই তাদের দৃষ্টি নিবন্ধিত। অন্যদিকে আছে পরিবারের মতো বন্ধনে গড়ে ওঠা চীনের শাসনপ্রবণ পিতৃসুলভ সরকার। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে তারা জনগণের প্রত্যাশায় না; দৃষ্টি রাখে জরুরি অবস্থার দিকে।
উভয় ব্যবস্থাতেই সুবিধা ও অসুবিধা আছে। কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার সমস্যা, তাতে সকল নাগরিককে একই নজরে দেখা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে এই অজ্ঞতা আত্মবিধ্বংসী হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্য দিকে স্টেকহোল্ডার মডেলে স্বচ্ছতা আর জনতার গোপনীয়তাকে শ্রদ্ধা করা হচ্ছে; যা গণতন্ত্রের নির্দেশক। কিন্তু জরুরি অবস্থায় সঠিক সময়ে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রশ্নের অবকাশ থাকে।
বর্তমানের কোনো সরকার ব্যবস্থাই ত্রুটিমুক্ত না। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা পরস্পরের থেকে শিখব। যে কোনো পক্ষের আদর্শিক গোড়ামি বিপদজনক ও ধ্বংসাত্মক।