কনফুসিয়াস: চীনে ‘মাস্টার কং’ নামে পরিচিত মহান দার্শনিক
হাজার বছর আগে কোনো একজন মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর দিন-তারিখ লিপিবদ্ধ রাখা বিস্ময়কর। চীনাদের কাছে ‘মাস্টার কং’ নামে পরিচিত মহান দার্শনিক কনফুসিয়াস-এর ক্ষেত্র তেমনি ঘটেছে। তার জন্ম (২৮ সেপ্টেম্বর ৫৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এবং মৃত্যুর (১১ এপ্রিল ৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) দিনক্ষণ কেবল লিখিতই নেই, দিন দু'টি অদ্যাবধি পালিতও হয়।
শুধু চীনে নয়, বিশ্ব বরেণ্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকের তালিকায় জ্বলজ্বল করে কনফুসিয়াসের নাম, যিনি সেই আদি যুগে এমনই মহত্তম কথা বলেছেন আর নীতিমালা নির্দেশ করেছেন, যা আজো চিন্তার জগতকে আলোড়িত করে। ভাবা যায়, আড়াই হাজার আগে, যখন অক্ষরজ্ঞান বা বই-পুস্তকের বিকাশই ভালো করে হয়নি, তখন তিনি বলছেন, 'চিন্তা না করে কেবল অধ্যয়ন করা অনর্থক, তবে অধ্যয়ন না করে চিন্তা করা বিপজ্জনক।' বলেছেন, 'যখন তুমি কোন ভালো মানুষকে দেখ, তার মত হওয়ার চেষ্টা কর। আর যখন কোন খারাপ মানুষকে দেখবে, তখন তোমার নিজের দুর্বলতাগুলোর দিকে নজর দিবে।'
মানবসত্ত্বা ও প্রবৃত্তিকে কনফুসিয়াসের মতো এতো স্পষ্টভাবে খুব কম দার্শনিকই শনাক্ত করতে পেরেছেন। তিনি বলেছেন, 'যদি তুমি কোন কিছু সঠিক মনে কর, কিন্তু সেই অনুযায়ী কাজ করতে না পারো, তবে তোমার সাহসিকাতার অভাব আছে।' তিনি আরো বলেছেন, 'তুমি নিজে যা করতে চাও না, অন্যকে তা করতে দিও না।'
অতএব কনফুসিয়াসের জ্ঞানের গভীরতা, প্রজ্ঞার প্রসারতা ও দূরদৃষ্টির বহুমাত্রিকতা যে হাজার বছর পরেও পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রহণীয় ও প্রাসঙ্গিক থাকবে, তা তো সহজেই অনুমান করা যায়। কনফুসিয়াসের নীতি ও আদর্শের প্রতি নজর দিলেও দেখা যায় এই প্রাচীন পণ্ডিতের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপ্তি ও উজ্জ্বলতা। তিনি বলেছেন: ১. সকলের সঙ্গে ভালো আচরণ করুন, তা শ্রেষ্ঠ ও নিরাপদ। ২. সু অভ্যাস গড়ে তুলুন এবং দৈনন্দিন কার্যপদ্ধতি মেনে চলুন, তাহলে সফল হবেন। ৩. একজন ব্যক্তির উত্তম মূল্যবোধ ও নৈতিকতা থাকা উচিত। ৪. পরিবার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন, পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রী, শিক্ষক-ছাত্র, দাস-মালিক ইত্যাদি প্রতিটি সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। ৫. প্রত্যেকের উচিত সবকিছুতে নতুনত্ব নিয়ে আসা। ৬. একজন ব্যক্তির যে গুণাবলী থাকা আবশ্যক, তা হলো সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরার্থপরতা, ধার্মিকতা ও আনুগত্য।
প্রাচীন চীনা শিক্ষাগুরু, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক কনফুসিয়াসে এমন বহু কথা ও নির্দেশনার উল্লেখ করা সম্ভব, যা বর্তমানকালেও সবাইকে চমকে দেয় এবং গ্রহণযোগ্য মনে হয়। তিনি বিশ্বসেরা প্রভাবশালী দার্শনিকের একজন, যিনি দর্শনকে মহত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত করে যুগ যুগ ধরে মানব জীবনে নীতিনিষ্ঠ পন্থায় চলার পথ দেখিয়ে চলেছেন।
৫৫১ খ্রিস্টপূর্বে চীনের লু’ স্টেটে কনফুসিয়াসের জন্ম। তার বাবা ‘কং’ ছিলেন একজন সৈনিক। কনফুসিয়াসের তিন বছর বয়সেই তার বাবা মারা গেলে মায়ের কাছে অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্যে বড় হন তিনি। তার পরিবার ছিল চীনের ‘শাই’ নামে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবার, যা অভিজাত পরিবার না হলেও কৃষকদের থেকে কিছুটা উপরে ছিল। ফলে শ্রেণি সম্পর্কে তিনি শৈশব থেকেই অবগত ছিলেন ও সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের চেয়ে ভিন্নতর পন্থায় চিন্তার করার ক্ষমতা লাভ করেন। যার ভিত্তিতে তিনি মনে করতেন, 'মানুষকে মর্যাদা দেয়া ও পুরস্কৃত করা উচিত তার মেধা দিয়ে, সে কোন পরিবারে জন্ম নিয়েছে তা দিয়ে নয়।'
কনফুসিয়াসের শৈশবের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়না। তবে তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেছিলেন একজন মেষ পালক হিসেবে। পরে বুক কিপার ও ক্লার্কের কাজ করেছেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনিই ছিলেন চীনের প্রথম কোন শিক্ষক যার লক্ষ্য ছিল সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা। চল্লিশ বছর বয়সে তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে তৎকালীন চীনা সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন এবং লু’ স্টেট শহরের গভর্নর পদ লাভ করেন।
কনফুসিয়াস ক্রমে ক্রমে সরকারের উপদেষ্টা র পদ লাভ করেন। সেই সময় লু' স্টেটের নেতৃত্বে ছিলেন একজন ডিউক, যার অধীনে ছিল তিনটি অভিজাত পরিবার, যারা সরকার নিয়ন্ত্রণ করত। কনফুসিয়াস এ ব্যবস্থার সংস্কার করে একটি কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি কিছুটা সফলও হয়েছিলেন, তবে পুরোপুরি সংস্কার করতে পারেননি। এরপর থেকে তার বেশ কিছু শত্রু তৈরি হয় এবং তিনি লু স্টেট ছেড়ে চলে যান।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি ভাষ্য পাওয়া যায়। আর তা হলো, সে সময় পার্শ্ববর্তী রাজ্যের এক রাজা লু’ স্টেটের রাজাকে ১০০টি ঘোড়া ও ৮০ জন সুন্দরী রমণী উপহার দেয়। এটা পেয়ে রাজা চরম আনন্দ-উল্লাস ও বিলাসিতায় মত্ত হয়ে পড়েন। এর প্রতিবাদে কনফুসিয়াস রাজ্য ছেড়ে চলে যান। তিনি চীনের বিভিন্ন শহর ঘুরে বেড়াতে থাকেন এবং তার রাজনৈতিক চিন্তা ও দর্শন প্রচার করতে থাকেন।
তার প্রচারিত দর্শন 'কনফুসিয়ানিজম' হিসেবে পরিচিত। কেউ কেউ এটাকে একটি ধর্মীয় আবার কেউ কেউ এটাকে ধর্মনিরপেক্ষ দর্শন হিসেবে বিবেচনা করেন। তার দর্শনে পরকাল ও স্বর্গের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার মতবাদ ধর্মীয় বিভিন্ন বিশ্বাস ও আচরণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তবে তিনি শক্তিশালী ও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন। তাঁর দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল ব্যক্তি ও সরকারের নৈতিকতা, সামজিক সম্পর্কের সংশোধন, ন্যায়বিচার ও আন্তরিকতা। ভদ্রতা, পরিকল্পনা, শ্রদ্ধাবোধ, নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও দায়িত্ববোধকে সাধারণ অনুভূতি থেকে ভিন্নভাবে লালন করার শিক্ষা দিয়েছেন তিনি।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি তিনি এই শিক্ষাও দিয়েছেন যে, মুল্যবোধই একটি সুখী জীবন গড়ে তুলার একমাত্র পাথেয়। তার মতে সুপরিকল্পিত কাজ এবং অন্যদের সহযোগিতার মাধ্যমেই প্রকৃত সুখ পাওয়া যায়। তার দর্শনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল কতিপয় লোককে সুবিধা না দিয়ে রাষ্ট্রের সবাইকে উপকৃত করা।
৪৭৯ খ্রিস্টপূর্বে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান মহান দার্শনিক কনফুসিয়াস। পরবর্তীতে কনফুসিয়াসের অনুসারীরা তার আদর্শকে ‘দ্য অ্যানালেক্টস অব কনফুসিয়াস’ গ্রন্থে তুলে ধরেছেন। চীনে হান রাজাদের শাসনামলে কনফুসিয়াসের শিক্ষা রাষ্ট্রীয় দর্শন ও দিকনির্দেশনা হিসেবে বিবেচিত হয়। তার দেয়া 'কর্তৃপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা' আদর্শ হিসেবে এখনও চীনা সংস্কৃতি ও সরকার ব্যবস্থায় অনুসরণ করা হয়।