শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানসম্পন্ন করতে হবে
শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। দেশকে উন্নতির পথে নিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশও জাতীয়ভাবে শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে উন্নত শিক্ষার নানা মডেল অনুসরণ করছে।
এ ধারায় এখন চলছে সৃজনশীল শিক্ষার অনুশীলন। সেই প্রথম শ্রেণি থেকেই শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃজনশীল মনন তৈরির জন্যই এ নয়া ব্যবস্থার প্রচলন এবং উন্নয়নের কাজ হচ্ছে। শিক্ষা গবেষণা, কারিকুলাম প্রণয়ন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ খাতে সরকারি তহবিলের পাশাপাশি অঢেল বিদেশি অনুদানের টাকাও খরচ হয়েছে।
তবে শুরু থেকেই এ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক ছিল এবং এখানো আছে। সৃজনশীলতা নামে বিশেষ করে শিশুদের মেধা এবং মননের উপর অতিরিক্ত চাপের কথা অভিভাবক মাত্রই স্বীকার করেন। সে চাপ শিক্ষার্থীর জন্ম ও প্রকৃতিগত সৃজনশীলতাকে কেড়ে নিচ্ছে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
অভিযোগ আছে, শিক্ষার্থীদের পড়া মুখস্থ করা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে স্বশব্দে পড়াও। ফলে শুদ্ধ উচ্চারণে বিষয়ভিত্তিক পাঠের শৈল্পিকতার বিকশিত হচ্ছে না অনেক শিক্ষার্থীর মাঝে।
তদুপরি শিক্ষায় নানা বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে নৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোকে উপেক্ষা করার বিষয়টিও অনেকেই চিহ্নিত করেছেন। বিশেষত, কিশোর এবং যুব সমাজের অব্যাহত অবক্ষয় এবং নৈতিক অধঃপতনজনিত অপরাধে বর্তমান প্রজন্মের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জড়িত হওয়ায় মূল্যবোধ ও নৈতিকতার প্রসঙ্গগুলো জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।
এ কথা সকলের জানা যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। যেখানে শিক্ষকগণ জ্ঞানের দিগন্ত উন্মোচিত করেন শিক্ষার্থীর জন্য। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পবিত্র সম্পর্কের মেলবন্ধনে আদর্শ শিক্ষক জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি নৈতিক আবশ্যকীয় মানবিক গুনাবলির সাথে পরিচিত করে আদর্শ শিক্ষার্থী ও প্রকৃত মানুষ পড়ে তোলেন।
প্রবাদে বলা হয়, 'বাপে বানায় ভুত, উস্তাদে বানায় পুত'। বাংলার মতো ইংরেজিতে শিক্ষা নিয়ে বহু বক্তব্য রয়েছে। যেমন, 'Education is the harmonious development of body, mind & mind.' এসব কথার শিক্ষার মূল লক্ষ্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বা শিক্ষার মৌলিক দর্শনকে উন্মোচিত করে।
প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষার এহেন আদর্শ মানদণ্ড প্রতিষ্ঠিত থাকলেও হাল আমলে শিক্ষায় নৈতিকতার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। শিক্ষকগণও অতীতে যেমন নৈতিক বলে বলীয়ান ছিলেন, তা অনুপস্থিত। অভিভাবকদের পক্ষেও সন্তানদের নিশ্চিন্তে শিক্ষকের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নির্ভরযোগ্য শিক্ষকের কথাও এখন আর ভাবা যায় না। মেয়ে শিক্ষার্থী শিক্ষকের পাশবিক লালসার শিকার হওয়ার অব্যাহত প্রবণতা, কিংবা শিক্ষার্থীর অপরাধের জন্য পিতামাতকে অপমান করায় খোদ শিক্ষার্থী যখন আত্মহননের পথ বেছে নেয়, তখন তো ভাবতেই হয়, কোথায় দাঁড়িয়ে আমাদের শিক্ষকগণ এবং শিক্ষাব্যবস্থা?
আধুনিক ও ধর্মীয়, উভয়বিদ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নামের মানুষ গড়ার কারখানাগুলো বিপদসংকুল হয়ে পড়েছে নিরীহ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য। কখনো আবার সহপাঠীরূপী হায়নাদের হাতে বুয়েটের আবরার নিহত হবার ঘটনা কিংবা সিলেটের এমসি কলেজের তথাকথিত ছাত্র কিংবা ছাত্র নেতাদের হাতে গৃহবধু ধর্ষিতা হবার মতো রোমহর্ষক ঘটনারও সৃষ্টি হচ্ছে।
তদুপরি, টানা কয়েক বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদালয়, প্রাইমারি সমাপনী থেকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের মতো ঘটনাই বলে দেয় সুযোগ পেলে কেউ কেউ কতোটা নীচে নামতে পারেন। আবার পিইসি, জেএসসি কিংবা এসএসসির মতো ছোটদের পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্ন খোদ অভিভাবকের হাত ধরেই মাসুম বাচ্চাদের হাতে যায়। এতে শিক্ষার্থীদের নৈতিকতার বারোটা বেজে যাচ্ছে।
কখনো কখনো প্রশ্ন ফাঁসের পরীক্ষার হলে ছাত্র/ছাত্রীদের নকল করার সুযোগ দেয়া কিংবা খোদ শিক্ষক কর্তৃক সমাধান সাপ্লাই দেয়ার ঘটনা থেমে নেই। ফলে অবক্ষয়ের একটি স্রোত বয়ে চলেছে শিক্ষা ব্যবস্থায়।
অথচ আগে ছাত্রদের মধ্যে শীর্ষ মেধাবীরা শিক্ষক হতো এবং যোগ্য শিক্ষকরা পদোন্নতি পেয়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পেতো। আর এখন মেধা নয় দলীয় বিবেচনায় কিংবা মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হয়। এবং একই বিবেচনায় শিক্ষকদের ভিসিসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ হয়। পরে তাদের কারো কারো দুর্নীতির পাহাড় পরিমাণ ফিরিস্তি মিডিয়ায় প্রকাশ পায়।
উচ্চশিক্ষার মতোই প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে কোচিং ব্যবসা, পছন্দের বই শিক্ষার্থীদের কিনতে বাধ্য করার মতো অনেক লাভজনক কাজ করা হচ্ছে, যাতে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণ না হলেও অনেকের পকেট ভারি হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরাজমান এমনই বহু গলদ ধ্বংস করছে শিক্ষার মান, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ। এইসব সমস্যা ও দুষ্টচক্রের কবলে শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থা আক্রান্ত। শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানসম্পন্ন করতে ও যোগ্য-মানবিক শিক্ষিত মানব সম্পদ গড়ে তুলতে এইসব সমস্যার মূলোৎপাটন করতেই হবে।