করোনা ও সংঘাতে আকীর্ণ আমেরিকা!
পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী ও শীর্ষ শক্তিশালী দেশ আমেরিকার এমন চেহারা দেখার কথা কেউ কল্পনাও করেনি। ২০০ বছরের পুরনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দেশটি কলঙ্কিত হয়েছে সহিংসতার রক্তাক্ত বহিঃপ্রকাশে। রাজনৈতিক সংঘাতে ধ্বস্ত হয়েছে শীর্ষ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে করোনার চরম আঘাতে আতঙ্কিত পুরো দেশ। করোনা ও সংঘাতে আকীর্ণ আমেরিকার এমন বিহ্বল ও বিপর্যস্ত চেহারা সত্যিই অভাবণীয় এবং অকল্পনীয়।
ক্যাপিটালে ন্যাক্কারজনক হামলার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার ইতিহাসে প্রথমবার প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট হিসাবে দু’বার ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হলেন আলোচিত-সমালোচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। বুধবার (১৩ জানুয়ারি) বিকালে (আমেরিকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী) হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে ট্রাম্পের ইমপিচমেন্ট নিয়ে ভোটাভুটি হয়। সেখানে ডেমোক্র্যাটরা ছাড়াও কিছু রিপাবলিকান সদস্যও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দেন। ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে ট্রাম্প সমর্থকদের তাণ্ডবের জেরেই ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হতে হচ্ছে ট্রাম্পকে।
প্রেসিডেন্টের ইমপিচমেন্ট প্রসঙ্গে ডেমোক্র্যাট সেনেটর চাক স্কুমার বলেছেন, 'ট্রাম্পই প্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যাঁকে দু’বার ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হতে হল। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভের মতো সেনেটকেও বিষয়টি কার্যকর করতে হবে।’
ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের জন্য ভোটাভুটির বিষয়টি স্পষ্ট হতেই আগ্রহ তৈরি হয়েছিল রিপাবলিকানরা কী করেন তা নিয়ে। সকলের আগ্রহ ছিল ক’জন রিপাবলিকান ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের পক্ষে ভোট দেন। ভোট শেষে জানা গিয়েছে, মোট ১০ জন রিপাবলিকান ট্রাম্পের অপসারণ চেয়ে ভোট দিয়েছেন। হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে ইমপিচমেন্ট নিয়ে ভোটের ফল ২৩২-১৯৭। এ বার বিষয়টি উঠবে সেনেটে। সেখানে দোষী সাব্যস্ত হলে ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আর দাঁড়াতে পারবেন না ট্রাম্প।
পুরো বিষয়টি ট্রাম্পের জন্য যত না লজ্জাজনক, তারচেয়ে বেশি বেদনার আমেরিকান ডেমোক্রেসির জন্য। আমেরিকার প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রে এমন নেতৃত্ব আর আসেননি, যিনি দেশকে বিভাজিত ও ক্ষমতার জন্য নারকীয় কাণ্ডের ইন্ধনদাতায় পরিণত হয়েছেন। বিশ্বে এবং স্বদেশে গণতন্ত্র, সহনশীলতা, সমানাধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার তথাকথিত ইমেজসম্পন্ন আমেরিকান গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত হওয়ার ঘটনাও এই প্রথম।
বিশ্বে গণতন্ত্র ও মার্কিন মূল্যবোধ যে শ্রেষ্ঠত্ব ও শীর্ষতা দাবি করে একাধিপত্য দেখিয়েছে বছরের পর বছর এবং বিশ্বকে নানাভাবে দখল ও নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাকেও তীব্রভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার উপযুক্ত উপাদান সরবরাহ করেছে আমেরিকায় সংগঠিত ঘটনাবলি। মুখে চুনকালি লাগানোর মতো ঘটনাগুলোতে আমেরিকার তথাকথিত ইমেজকে সত্যিকার অর্থেই তলানিতে নিয়ে গেছে।
রাজনৈতিকভাবে বিপন্নতা ছাড়াও আমেরিকা বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে প্রায়-তছনছ হয়ে গেছে। এক মিনিটে তিন জন আমেরিকাবাসীর মৃত্যু ঘটছে করোনায়! করোনা-অতিমারি কালে অভিশংসনের দিনটি বুধবার (১৩ জানুয়ারি) ছিল আমেরিকার সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪৭০ জন, যা পুরনো রেকর্ড ভেঙে তৈরি করেছে মৃত্যুর নতুন রেকর্ড।
কোভিড-১৯ বিস্তারের পর থেকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আমেরিকা। দীর্ঘদিন ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যু তালিকায় শীর্ষে রয়েছে তারা। গোটা বিশ্বে আক্রান্ত ৯ কোটি ২১ লক্ষ। এর মধ্যে শুধু আমেরিকাতেই করোনা-সংক্রমিত ২ কোটি ৩৩ লক্ষ মানুষ। ১৯ লক্ষ ৭২ হাজার মৃত্যুর মধ্যে ৩ লক্ষ ৮৯ হাজার প্রাণহানি প্রথম বিশ্বের এই দেশে। হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে উপচে পড়ছে রোগীর ভিড়।
ক্যালিফর্নিয়ার একটি ছোট শহর অ্যাপল ভ্যালির সেন্ট মেরি হাসপাতালের চিকিৎসক কারি ম্যাকগুয়ার বলেন, ‘আমার সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এত অন্ধকার পরিস্থিতি আর দেখিনি। আমার চেনা-পরিচিত, কাছের অনেকের চিকিৎসা করেছি। দেখেছি কত প্রিয়জনের চলে যাওয়া।’
সংবাদমাধ্যম প্রদত্ত খবরে বহু হাসপাতালেই হলগুলোতে আপৎকালীন শয্যা তৈরি করা হয়েছে। অতিরিক্ত আইসিইউ বেড প্রস্তুত হয়েছে। এমনকি শিশু বিভাগও উপচে যাচ্ছে রোগির ভিড়ে। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকা সরকার ঘোষণা করেছে, ২৬ জানুয়ারি থেকে কোভিড-নেগেটিভ রিপোর্ট ছাড়া কাউকে দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
করোনার মারাত্মক আঘাতের বিপর্যয় শুধু স্বাস্থ্যগত ক্ষেত্রে বা আক্রান্ত-প্রাণহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। চরমতম আর্থিক বিপদের কারণও ঘটিয়েছে। অকাতরে চাকরি হারাচ্ছে লোকজন। বাড়ছে বেকারত্ব। ধ্বংস হচ্ছে ক্ষুদ্র, মাঝারি শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য। অনেক জায়গাতেই শুরু হয়েছে খাদ্যের জন্য হাহাকার। দাতব্য খাদ্য ভাণ্ডার বা 'ফুড ব্যাঙ্ক'-এ দীর্ঘ লাইন দিয়ে হাত পেতে খাবার নিচ্ছে অসহায় মানুষ।
যে অতীত গৌরবময় নেতৃত্ব একটি নতুন ও অভিবাসীদের দেশ আমেরিকাকে শক্তিতে ও সম্পদে বিশ্বসেরা করেছিল, বর্তমান নেতৃত্বের অধঃপতন ও অবক্ষয়ে সে দেশ এখন ঘোরতর সঙ্কুল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছে। ফলে, যে অসহায়, বিপন্ন ও হতবিহ্বল আমেরিকার চেহারা এখন দেখা যাচ্ছে, তা কাটানোই দেশটির সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাইডেন-কমলার নতুন নেতৃত্ব সঙ্কট ও সংঘাতের গহ্বরে ঠেলে দেওয়া আমেরিকাকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভাবে কতটুকু উত্তরণ ও পুনরুদ্ধার ঘটাতে পারেন, সেটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।