ভাষাসৈনিক ডা. মাজহারুল হকের স্মৃতিতে প্রথম শহীদ মিনার



আশরাফুল ইসলাম
ভাষাসৈনিক ডা. মাজহারুল হক

ভাষাসৈনিক ডা. মাজহারুল হক

  • Font increase
  • Font Decrease

ঢাকা মেডিকেল কলেজের আদি পর্বের ছাত্র ডা. এ. এ. মাজহারুল হক সরাসরি অংশ নেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ তিনি যুক্ত ছিলেন প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে। কিশোরগঞ্জে বসবাসকারী এই ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জানিয়েছেন ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত একুশে ও প্রথম শহীদ মিনার গড়ার স্মৃতিকথা।

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর একটি দিন। এ দিনেই হোস্টেলের পার্শ্বে ঢাকা মেডিকেলের প্রাঙ্গণে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের প্রাথমিক কাজটি সম্পন্ন হয়। সে দিন নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’টিই পরবর্তীকালের শহীদ মিনার।

আজকে যে শহীদ মিনার, সেটা শুরুতে নির্মিত হয়েছিল মাত্র এক রাত্রের মধ্যে। সেই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হতে শুরু করে নির্মাণ পর্যন্ত সবটুকু কৃতিত্ব যারা সে সময়ের ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র, তাদের।

এক একান্ত সাক্ষাৎকারে প্রথম শহীদ মিনার তৈরির ইতিহাস ও ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে এসব কথা জানান মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে অংশ নেয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজের আদিপর্বের ছাত্র ডা. এ.এ. মাজহারুল হক।

ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মাতৃভূমির প্রায় প্রতিটি বিজয়-সংগ্রামেই, বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অবদান রাখেন।

১৯৪৬-৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে প্রবলভাবে যুক্ত থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনে সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে তিনিই প্রথম মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতার ঘোষণা অবহিত ও প্রচার করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে নিজ বাসভবনেই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন রক্তপাতহীনভাবে কিশোরগঞ্জের পতন ঘটিয়ে সেখানে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেন।

প্রায় ৬৮ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা-সমাজসেবা-রাজনীতির মহানব্রত পালনের মাধ্যমে বিশিষ্ট ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মাজহারুল হক বর্তমানে কিশোরগঞ্জে অবসর-জীবন-যাপনরত।

ভাষা আন্দোলনে ডা. মাজহারুল হকের ব্যক্তিগত সংযোগ স্মৃতির ঘটনাটি ২০০৭ সালে জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে আলী হাবিব বিস্তারিত লিখেছেন। তিনি যথার্থই উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা এক রাতের মধ্যে এ প্রশংসনীয় কাজটি করেছিলেন।”

ডা. মাজহারুল হকসহ মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের সরাসরি ও প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের সেসব কথা শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে জড়িত অপর এক ছাত্র সাঈদ হায়দার তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: “মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহীদ মিনার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। বিকেল থেকে কাজ শুরু হয়। শেষ হয়  ভোরে।”

ডা. মাজহারুল হক জানান: “আমরা এক প্রকার গেরিলার মত গোপনে নির্মাণ কাজ চালিয়ে ছিলাম। ইট, বালি, সিমেন্ট সংগ্রহ করেছিলাম। ঘোষণা দিয়ে ঘটা করে তা নির্মাণ করা হয় নি কৌশলগত কারণে। পূর্বাহ্নে জানতে পারলে পাকিস্তানপন্থীরা সেটা গড়তেই দিত না।

আমরা নির্মাণ-সংক্রান্ত যোগার-যন্ত্র ও অন্যান্য আয়োজন নির্ধারণ করে পালাক্রমে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ চালিয়ে গভীর রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কাঁচা হাতে শহীদদের রক্তদানের পবিত্র স্থানে মাথা উঁচু করা স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।

সেই দিনের উত্তেজনা আজও মনে আছে। শহীদ শফিউরের পিতাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন সাহেব। পরপরই আমরা ফুল ও শ্রদ্ধার মালায় শহীদ মিনার ভরে তুললাম।

সারা দিনই বিপুল ছাত্র-জনতা এভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করল। সেদিনই শেষ বিকালের দিকে সরকারের পক্ষ হতে শহীদ মিনারের উপর আক্রমণ চালানো হল। তছনছ করে দেওয়া হল স্মৃতি ও শ্রদ্ধার মিনার।

পুলিশ অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে আদি শহীদ মিনারটি সম্পূর্ণরূপে গুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দিল এবং আমাদের মেডিকেল হোস্টেলে আক্রমণ করল। জীবনে প্রথমবারের মত পুলিশী নির্যাতনের শিকার হলাম।

আহত অবস্থায় আমাদেরকে থানায় নিয়ে গিয়ে শাসিয়ে দেওয়া হল। বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে আটক করে রাখার মত স্থান হয়তো থানা-পুলিশের ছিল না। গণগ্রেফতার করে আন্দোলনকে আরও বেগবান করার পথে তারা অগ্রসর হল না।

সংক্ষিপ্ত আটকাবস্থা, জেরা ও খবরদারীর পর আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। হলে ফিরে এসে দেখলাম উদ্বিগ্ন বন্ধু-বান্ধব অপেক্ষমাণ। আমাদেরকে অতি দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হল। দীর্ঘ ৬৯ বছর পূর্বের ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতি আজও আমাকে রোমাঞ্চিত করে।”

পঞ্চাশ দশকের সূচনাতেই ডা. মাজহারুল হক ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তাজাস্মৃতি নিয়ে কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ ছেড়ে  চিকিৎসায় উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় পুরাতন ঢাকার আলু বাজারের ১১৭ নং লুৎফর রহমান লেনের এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন।

কিন্তু বাংলাদেশের লোক হয়েও তিনি পাকিস্তানের তৎকালীন বিদ্যমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে দেশের একমাত্র মেডিকেলে ভর্তি বিষয়ে আশা-নিরাশার আক্রান্ত হন। তবে হতাশ না-হয়ে খুব মন দিয়ে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে তিনি তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও ভর্তি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে মেডিকেলে প্রবেশের সুযোগ পান।

ঢাকা মেডিকেলের প্রথম দিকের ক্লাসগুলোতে ডা. মাজহারুল হক আলু বাজার হতেই যোগ দিতে থাকেন। প্রায় দুই মাইল হেঁটে তাঁকে ক্লাসে উপস্থিত হত। তাঁর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হত সকাল ৮টায় এবং শেষ হত দুপুর দুইটায়।

ক্লাসে সহপাঠী হিসাবে অনেক অবাঙালি ও কলিকাতা প্রত্যাগতের দেখা পান তিনি। সহপাঠীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন: ফজলে রাব্বী ও আলীম চৌধুরী (শহীদ বুদ্ধিজীবী), ওয়ালীউল্লাহ (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ভাই), প্রয়াত ডা. আ. মান্নান (কটিয়াদী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য), আ. গফুর (বাসদ নেতা আবদুল্লাহ সরকারের ভাই), চট্টগ্রামের হারুন (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)। তাঁদের কাছে জহির রায়হান নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। ডা. আলীম চৌধুরী তাঁর বিশিষ্ট বন্ধু ছিল এবং তাঁরা শিল্প-সাহিত্য কর্মকাণ্ডে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিল।

ঢাকা মেডিকেলে অধ্যয়নের সময় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মত জাতীয় রাজনীতির ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সরাসরি সম্মুখীন হন তিনি এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজে ও সহপাঠীগণ তাতে অংশ গ্রহণ করেন। ততদিনে আলু বাজারের ঠিকানা হতে তিনি ব্যারাক নামে পরিচিত মেডিকেল হোস্টেলে এসে স্থায়ী হন।

ইত্যবসরে রাজনীতিতে নানারূপ পরিবর্তন সাধিত হল। ভাষার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্রও তৈরি হয়ে গেল। জিন্নাহর বক্তব্য ও পাকিস্তানপন্থী নেতৃবৃন্দের জাতি-বিরোধী অপতৎপরতায় বাঙালিদের মধ্যে সঞ্চারিত ক্ষোভ আরও ঘনীভূত হল এবং সংগ্রাম পরিষদের ভাষার দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম ও জনমত গঠন অব্যাহতভাবে চলতে লাগল।

সামগ্রিক পরিস্থিতি এরূপ ছিল যে, পশ্চিমা ও তাদের মোসাহেবদের শোষণ-নিপীড়ণমূলক রাজনীতিতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেল। সর্বত্র বাঙালিরা কোণঠাসা হয়েছিল। এহেন অবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলার স্থলে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা রূপে চাপিয়ে দেওয়ায় মানুষ মরিয়া হয়ে গেল।

বাঙালি ও বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে ক্রমে ক্রমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সমগ্র ছাত্রসমাজও ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই কারণে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেই উত্তাপ-উত্তেজনায় মেডিকেলের ছাত্ররাও প্রবলভাবে ভাগীদার হন।

১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ডা. মাজহারুল হক খবর পান, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দিতে এসে ঘোষণা দিয়ে উর্দুকে বাংলার উপরে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে বসিয়েছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে ঢাকা শহর বিদ্যুতের স্পর্শে চমকে উঠল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে নানা কর্মসূচির খবর তাঁদেরকে জানান হল। শহরের সর্বত্র উত্তেজনা দেখা দিল। পুলিশ রাস্তায় নেমে এল ও ১৪৪ ধারা জারি করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করল।

কিন্তু আন্দোলনরত ছাত্রদের দমান গেল না। ছাত্রদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও সামিল হলেন। তাৎক্ষণিকভাবে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ তো অনুষ্ঠিত হলই; আরও হরতাল-সভা-সমাবেশের সূচনা হল।

৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হল। ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, অলি আহাদ, গাজিউল হক, আবদুল মতিন প্রমুখের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ হল।

এভাবে জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে ফেব্রুয়ারি মাস এল। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটিই যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। এমন কোন দিন ছিল না আন্দোলনহীন। প্রত্যহ ভাষার দাবিতে মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে।

৪ ফেব্রুয়ারি ঘটল এক অভূতপূর্ব ঘটনা। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহুত একটি বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বের হল। মেডিকেলে ছাত্ররাও উক্ত মিছিলে যোগদান করে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রকাশ্য রাজপথে দাবি জানাল। ডা. মাজহারুল হক ছিলেন সে মিছিলের সামনের কাতারে।

বিশাল মিছিল নিয়ে তাঁরা শহর প্রদক্ষিণ করে উপস্থিত হন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবনের সামনে। বর্তমানে যা বাংলা একাডেমী, তার ভেতরে পুরাতন যে বাড়িটি এখনও রয়েছে, সে বাড়িটির নাম বর্ধমান হাউস। এই বর্ধমান হাউসই ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন।

তাঁরা স্লোগানে মুখরিত মিছিল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হলেন। সে স্মরণীয় মিছিলই নয়, ডা. মাজহারুল হক বন্ধু-বান্ধবরা নিয়মিতভাবে একই ভবনের প্রতিবেশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিল-সমাবেশে গিয়ে মিলিত হতে থাকেন।

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে বর্তমানের মতো এতো বিরাট ক্ষেত্র ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দৃশ্যত বর্তমান ঢাকা মেডিকেলের সঙ্গে লাগানো ছিল। বর্তমান শহীদ মিনার ও মেডিকেলে ইমার্জেন্সির আশে-পাশেই সকল আন্দোলন কর্মকাণ্ড চলছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনিসহ মেডিক্যালের সহপাঠীগণ এসবের কেন্দ্রস্থলে ছিলেন এবং মেডিকেল ছাত্ররা নৈতিক ও মানসিকভাবে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে যুক্ত থাকেন।

ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখের দিকে ছাত্র আন্দোলন সুতীব্র হল। অনেকে গ্রেফতার বরণ করলেন। সরকার এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা বহাল করল। সভা-সমাবেশ-হরতাল নিষিদ্ধ করা হল। কিন্তু সবাই তখন সংগ্রামমুখর। বাংলার ছাত্র সমাজ তখন অকুতোভয়। কে তাদেরকে রুখবে! এমন সাধ্য কার!! রাত্রি বেলাতেই সিদ্ধান্ত জানা গেল যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে। সমাবেশ হবে। মিছিল হবে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চলবেই।

রাত্রি শেষে এলো ২১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকাল হতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার পরিস্থিতি আপাত দৃষ্টিতে শান্তই ছিল। ২১  ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ৫জন ৫জন করে ১৪৪ ধারার ভেতরেও মেডিক্যালে আমাদের হোস্টেল, যা ব্যারাক নামে পরিচিত ছিল, তার সম্মুখে সমবেত হতে লাগল। আজিমপুর ও সলিমুল্লাহ হলের দিক হতেও লোকজন আসতে লাগল। মধুর ক্যান্টিনের দিকেও ছাত্ররা সংগঠিত হল।

অবিরাম ছাত্রস্রোত রুদ্ধ করতে প্রথমে পুলিশের পক্ষ হতে শুরু হয় লাঠিচার্জ। এর পর শুরু হল টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। কিন্তু কোনওভাবেই বিক্ষোভ দমন করা সম্ভব হল না। বেলা যতই বাড়তে লাগল, ততই বিক্ষোভ তীব্রতর হতে লাগল; প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জনসমাগমও হু হু করে বৃদ্ধি পেল। বিশ্ববিদ্যালয় মাঠ, মেডিকেল কলেজ গেইট প্রভৃতি এলাকায় ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ সমাবেশ পুঞ্জিভুত হতে লাগল।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে সংহতি জানাতে হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় হতে শুরু করে হল বয় পর্যন্ত এসে মিছিলে একাত্ম হল। এরই মধ্যে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের সংঘর্ষ আরম্ভ হল।

এমন অবস্থায় বেলা তিন ঘটিকার দিকে রাজপথে দাঁড়িয়েই ডা. মাজহারুল হক অতি নিকটেই পুলিশের বন্দুক হতে হঠাৎ গুলি বর্ষণের আওয়াজ শুনতে পান। প্রচণ্ড উত্তেজনা ও হৈ চৈ-এর মধ্যে আন্দোলনরত ছাত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সন্নিকটে অবস্থিত মেডিক্যাল হোস্টেলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বহুজন আহত হল। আহত ও নিহতদের ইমার্জেন্সিতে নেওয়া হল।

তিনিসহ মেডিকেলের ছাত্ররা ইমার্জেন্সিতে ছুটে গিয়ে বহু আহতকে কাতরাতে দেখলেন। স্বাধীন দেশে পুলিশের নির্মম অত্যাচারের চিত্র যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা দেখে সবাই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ আবুল বরকতকে দেখতে পেলেন তিনি। বরকতের তলপেটে গুলি লেগেছিল। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসাবে তিনি সকলের চোখের সামনে দিয়ে পরপারের পথে চির বিদায় নিলেন।

 

শহীদ আবুল বরকতের পর গুলিবিদ্ধ হন রফিকুদ্দিন। তিনি ছিলেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র। তাঁর পিতা ছিলেন বাদামতলীর কমার্শিয়াল আর্ট প্রেসের মালিক।

২১ ফেব্রুয়ারির আরেক শহীদ আবদুল জব্বার। তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে লক্ষ্মীপুরে ডা. মাজহারুল হকের গ্রামের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে প্রবাহিত পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম পার্শ্বে গফরগাঁও থানার পাঁচুয়া গ্রামের এই ভাষা-শহীদ ঢাকা মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে এক আত্মীয়-রোগী ভর্তি করতে এসেছিলেন। তিনি মেডিকেল কলেজ হোস্টেলেই নিজ এলাকার একজন ছাত্রের কক্ষে এসে উঠেছিলেন।

গত কয়েকদিন যাবত তাঁকে কলেজ ক্যান্টিন ও হাসপাতালে দেখেছিলেন ডা. মাজহারুল হক। অদৃষ্টের ইঙ্গিতে তিনিও শহীদের তালিকায় নাম লিখালেন।

ডা. মাজহারুল হক চোখের সামনে রক্ত, মৃত্যু আর আহতদের আহাজারি দেখে ক্ষণকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন বটে। কিন্তু সেই সুতীব্র আঘাত ও আক্রমণ তাঁদের মধ্যকার একটি ঘুমন্ত-ক্ষত-বিক্ষত বাঘকে জাগিয়ে দিল। বন্ধু-সহপাঠীদের মধ্যেও তিনি লক্ষ্য করলেন অভিন্ন ক্ষোভের লেলিহান অগ্নিশিখা প্রজ্বলিত হয়েছে।

এরপর দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারির সকাল হতেই দলে দলে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকা মেডিকেল চত্বরের যেখানে শহীদদের জানাজা হওয়ার কথা ছিল, মৃতদেহ না পাওয়ার সেখানেই গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হল। গভীর রাত্রে সরকারের লোকজন গোপনে মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে আন্দোলনকে চাপা দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু তা ব্যর্থ হল। কমপক্ষে এক লক্ষ মানুষ জানাজায় অংশ গ্রহণ করতে সমবেত হয়। তৎকালের ঢাকায় উক্ত জনসমাবেশ সুবিশাল জনসমুদ্ররূপে সকলের কাছে মনে হল। ছাত্ররা তো বটেই শিক্ষকবৃন্দ কিংবা নগরীর প্রবীন নাগরিকগণও এরূপ জনসমুদ্র ইতিপূর্বে ঢাকা শহরে দেখতে পায় নি। গায়েবানা জানাজার বিষয়টিও ঢাকা তথা বাংলাদেশে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত  হয়েছে বলে শুনতে পেলেন তিনি।

২১ ফেব্রুয়ারির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল মূলত মিছিল ও প্রতিবাদের দিন। সমগ্র ঢাকা শহরকে সেদিন মিছিলের নগরীরূপে দেখতে পাওয়া গেল। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা রাজপথ প্রকম্পিত করে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ প্রকাশ করতে লাগল।

বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতিবাদ মিছিলে ২২ ফেব্রুয়ারিও গুলি চলল। সে দিন প্রাণ হারালেন শফিউর রহমান। তিনি ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী।

জানা গেল যে, তিনি তাঁর বাসা হতে সাইকেল চালিয়ে অফিসে আসছিলেন। কিন্তু নবাবপুরের মোড়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হলেন।

রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁকে মেডিকেলে আনার খবর পেয়ে ডা. মাজহারুল হক বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ছুটে গিয়ে জানতে পারেন যে, শহীদের তালিকায় নাম লিখিয়ে পরলোকের পথে পাড়ি জমিয়েছেন। আহত-নিহতদের দেখতে ঢাকা মেডিকেলে জনস্রোত নেমে এল। অনেক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও আসলেন।

ডা. মাজহারুল হক মনে করেন যে, তিনি যত সংখ্যক রক্তাক্ত লোক দেখেছেন,  তাতে উক্ত চার জনই শহীদ হয়েছেন বলে ধারণা করা কষ্টকর। তিনি হাসপাতালের নিম্ন শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে কানাঘুসা শুনতে পান যে, পুলিশ ও ইপিআর অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছ। ফলে সেসব অনামা শহীদদের নাম-পরিচয় জানা সম্ভব হয় নি। তিনি দাবি করেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের বিস্তারিত বিবরণ জাতির রাজনৈতিক ঐতিহ্যে প্রয়োজনে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা উচিত।

লেখক: আশরাফুল ইসলাম, প্রধান সম্পাদক, কিশোরগঞ্জ নিউজ।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;