বাবা দিবসে ব্যর্থ বাবার অনুভূতি
পৃথিবীব্যাপী মা দিবসের উজ্জ্বলতা বাবা দিবসের চেয়ে বেশি। এ কারণে ‘রত্নগর্ভা মা’ পুরস্কার দেয়া হলেও ‘রত্ন জন্মদাতা পিতা’ পুরস্কারের প্রচলন নেই।
আমার কাছে আমার বাবার স্মৃতি নেই। এটুকু জানি, আমি সেই ব্যর্থ সন্তান, যে তার বাবাকে কোনোদিন একটি উপহারও কিনে দিতে পারেনি। ছাত্রাবস্থায় আব্বা ইন্তেকাল করেন। সামান্য বেতনের সরকারি চাকুরি করে তিনি আমাদের জন্য কতকিছু করেছেন। কোনো ঈদে একটিমাত্র জামা কিনে দিয়ে বলেছেন, সামনের ঈদে তোকে ভালো জুতো কিনে দেবো। আমি বলেছি, জ্বি আব্বা, আমার জামা ভালো আছে। আপনি আম্মাকে শাড়ি কিনে দিন। অন্ধকার মুখে বাবা নীরব থেকেছেন।
আমাদের প্রতি আব্বার ভালোবাসা ছিল অব্যক্ত। এখন ভাবি, ছাত্র থাকাকালীন আমি স্কলারশিপের টাকা বাঁচিয়ে কেন আব্বাকে কিছু কিনে দেইনি। নিজেকে অপরাধী ভাবি। এখন সামর্থ আছে। সুযোগ নেই।
তবে এ ব্যাপারে আমার সন্তানরা আমার চেয়ে সফল। তাদের কাছে তাদের বাবার অনেক স্মৃতি আছে। কষ্টের। আনন্দের। পাঁচমিশাল স্মৃতি। গত ঈদে ছোট মেয়ে আমাদের সঙ্গে ঈদ করে। অনেক নিষেধ করেও তাকে তার আব্বু আম্মুর জন্য জামা-কাপড় কেনা থেকে নিবৃত করা যায়নি। ২০১৮ সালে বড় মেয়ের বস্টনের বাসায় আলাপকালীন বলি,
: শপিং মলে গেলে আমাকে একটু সঙ্গে নিও।
: কেন আব্বু?
: স্পোর্টসওয়্যারের দোকান থেকে হাঁটার জন্য একটি ট্রাউজার কিনবো। ল্যাপটপে ব্যস্ত মেয়ের ছোট্ট জবাব
: আচ্ছা আব্বু।
পরদিন ডোরবেল বাজলে মেয়ে আমাকে অনুরোধ করে বলে
: আব্বু একটু নীচে দেখে আসবে আমার নামে কোনো প্যাকেট এসেছে কিনা।
আমি নীচে গিয়ে তার নামে অ্যামাজন থেকে আসা একটি প্যাকেট এনে তার হাতে দিতে গেলে সে বলে
: ওটা তোমার প্যাকেট আব্বু।
: আমার! এখানে তো তোমার নাম লেখা।
: খুলে দ্যাখো।
আমি খুলে দেখলাম অ্যামাজনের তৈরি একটি উন্নত কোয়ালিটির ট্রাউজার।
: কিভাবে এল?
: গতকাল তুমি শপিং মলে যাবার কথা বলার সময়ে আমি ল্যাপটপে ছিলাম। তখনই অর্ডার করে দিয়েছিলাম।
: সাইজ জিজ্ঞেস করবে না?
: আব্বু! আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার। পরেই দেখ সাইজ হয় কিনা। পরে দেখলাম পারফেক্ট। ট্রাউজারটি খুবই আরামদায়ক। আমি এটি পরে এখনো হাঁটি। প্রায় বছর তিনেক পর বেশি ব্যবহৃত হওয়ায় এর পেছনের সেলাই খুলে গেলে স্ত্রীকে দিয়ে সেলাই করিয়ে নিয়েছি। যতবার ছিড়বে ততবার আমি এটি সেলাই করাবো। কারণ, নতুন ট্রাউজার এর বিকল্প হতে পারে না। এটি পরে হাাঁটলে মনে হয় সন্তনের ভালোবাসা গায়ে জড়িয়ে আছে। ছোটো মেয়ের দেয়া পাঞ্জাবি পরে জুম্মার নামাজে যাই। আতর থাকলেও মাখি না। মনে হয় মেয়ের ভালোবাসার ঘ্রান শরীরে লেপ্টে আছে।
আর উদাহরণ দেবো না। আমাদের মেয়েরা পিতৃভালোবাসার উদাহরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। আমি পারিনি। আমি একজন যুগপৎ ব্যর্থ সন্তান ও বাবা। মেয়েদের শৈশবে তাদের কিনে দিতে পারিনি দামি পোষাক। বিনোদনে স্পটে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারিনি। সোনার অলঙ্কারের পরিবর্তে বানিয়ে দিয়েছি নারকেলের পাতার চশমা ও ঘড়ি। তবে তাদের প্রতি ভালোবাসার উষ্ণতায় কমতি ছিল না। এখনো নেই।
লেখক: প্রফেসর, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।