শহরের আইকন
মফস্বল শহরগুলোতে এখনও বৈশ্য সংস্কৃতির মাতাল হাওয়া তীব্র তাণ্ডব ছড়াতে পারে নি। পারিবারিক, সামাজিক মেলামেলার সময় ও ফুসরত মানুষের আছে। নামে ও চেহারায় পুরো শহরের ছোট্ট চৌহদ্দির সবাই সবাইকেই ব্যক্তিগতভাবে জানে ও চেনে।
শরৎ সাহিত্যের এডভেঞ্চার প্রিয় ইন্দ্রনাথের মতো চরিত্রগুলো এইসব মফস্বল শহরে আকসার দেখা যায়। আস্ত একটি জীবন একটি পাড়ায় কাটিয়ে শহরের অলিখিত চিরকালীন নাগরিকে পরিণত হন তারা। মানুষের-পরিবারের বিপদে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক তৎপরতায়, ভ্রমণে ও বনভোজনে এমন চরিত্র যাবতীয় দায়-দায়িত্ব মাথায় নিয়ে থাকেন সামনের কাতারে। মধ্যরাতে বিপদাপন্ন রোগিকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কাউকে না পাওয়া গেলেও এরাই ছুটে আসেন সবার আগে।
কিশোরগঞ্জ শহরে এমন চরিত্র এখন একজনই: 'শেখর ভাই'। আগের প্রজন্মে কচি ভাই, খাইরুল ভাই এমন কয়েকজনকে শহরের সব কাজে পাওয়া যেতো অগ্রণী রূপে। দুই পাড়ার মারামারি থামানো থেকে শাসিল-দরবার করে শান্তি স্থাপনের সামাজিক দায়িত্ব তারাই পালন করতেন। এখন ষাটস্পর্শী শেখর ভাই পালন করছেন এইসব সামাজিক কৃত্যকর্ম।
আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলার অন্যতম সেরা গোলকিপার পিতার উত্তরাধিকার বহন করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনীতি শেখর ভাইয়ের অবলম্বন। গুরুদয়াল কলেজের ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। নির্বাচন করেছেন। ভাইবোনরাও আওয়ামী রাজনীতির নানা পর্যায়ে জড়িত।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে ছুটেন তিনি গভীর আবেগে। পহেলা বৈশাখে, একুশে ফেব্রুয়ারিতে, স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসে তরুণ-যুবক প্রজন্মকে নিয়ে মেতে থাকেন সারাক্ষণ। নাটকেও সময় দেয়। আর পছন্দ করেন মাঠ, ময়দান, খেলাধুলা। সবাইকে নিয়ে সারা শহর মাতিয়ে অনেক পরিশ্রমের পর শেখর ভাই তৃপ্তির হাসিতে বাড়ি ফেরেন।
কখনও কখনও তার দেখা পাওয়া যায় না। বেশ কয়েকদিনের জন্য থাকেন লাপাত্তা। পরে জানা যায়, কোন মরণাপন্ন রোগিকে নিয়ে ডাক্তার-হাসপাতালে ছুটাছুটিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিংবা কোনও স্বজন বা বন্ধুর বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিংবা কোনও পাহাড়ি এলাকায় ঘুরতে চলে গিয়েছিলেন বন্ধুদের নিয়ে।
সারাটা জীবন শেখর ভাইয়ের কেটে যাচ্ছে মানুষ ও সমাজকে আবর্ত করে। জাগতিক দিক থেকে সাফল্য অর্জনের চেয়ে সবাইকে নিয়ে হাসিখুশিতে থাকাই তার কাছে বেশি প্রিয়। কিশোরগঞ্জের শেখর ভাইয়ের মতো এমন চরিত্র সমাজে খুব একটা দেখা যায় না আজকাল।
মাঝে মাঝে মনে হয় প্রাচীন চরিত্র ইন্দ্রনাথের অনুরূপ শেখর ভাইয়ের মাঝে এসে মিশে যায় হুমায়ুন আহমেদের 'হিমু'। মনখারাপের উদাসী অনুভব তাকে আচ্ছন্ন করে। তখন তিনি পুত্র হিমালয়কে নিয়ে একমনে হাঁটছেন কিংবা অনির্দিষ্টভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কারও সঙ্গে দেখা হলে বলছেন দার্শনিকতার কোনও কথা।
শহরের আইকন হয়ে শেখর ভাই মৃত নরসুন্দা নদী তীরের কিশোরগঞ্জে জীবনের হাসি ও কান্নার প্রতিচ্ছবির মতো উদ্ভাসিত হন।