দরবেশের সাম্রাজ্যে ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’
বঙ্গদেশে একদা শাসনভার আসিয়া পড়িয়াছিল নামের অধুনালুপ্ত দুটি দলের ওপর। দুইটি আলাদা দল হইলেও ভোটাভুটির পর গাঁট বাঁধিয়া তাহারা রাজসিংহাসনে সমাসীন হইলো। ক্ষমতার পালাবদলে সাথে সাথে সরকারি নানা প্রতিষ্ঠানও দখলে নামিলেন তাহাদের দাসগণ। ইহার ব্যতিক্রম ঘটে নাই মতিহারেও। মাত্র কিছুদিনের তফাতে মহামান্য নতুন ফরমান জারি করিলেন। এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উজিরে আজম নিযুক্ত করা হইলো ফারুকিয়াকে। ক্ষমতা লইয়াই তিনি মনোনিবেশ করিলেন, অনুগত পারিষদ গঠনের দিকে। এরপর মহারানীকে খুশি রাখিতে সর্বান্তকরণে উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। এভাবেই শুরু হইলো ফারুকিয়া আমল।
স্বাধীন রাষ্ট্রে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করিবেন ফারুকি-ইহাই পণ করিয়া বসিলেন। কারণ, মহারানীর দরবারে সেই মুচলেকা পেশ করিবার পরেই ক্যাম্পাসে শাসনকর্তা রূপে তাহার পর্দাপণ ঘটিয়াছিল। মসনদে অধিষ্ঠিত হইবার পরই মহারানীর পদদলে নিজের তখত মজবুত করিতে মনোযোগী হইলেন ফারুকী। দলীয় পায়েক-পেয়াদা থেকে শুরু করে অধ্যাপক বানানোর কারখানায় পরিণত হইলো বিশ্ববিদ্যালয়টি। দলে দলে অধ্যাপক হইলেন অধ্যাপকদের উত্তরসূরিরা। এক্ষেত্রে মতিহার প্রাঙ্গণের রেওয়াজ মানিয়া চলিলেন তিনিও। যখন যে দলের উজির-নাজির নিযুক্ত হইয়াছে, সকলেই এই একটি কর্মেই চরম নৈপূণ্য দেখাইয়াছেন। মুখে মুখে রটনা রহিয়াছে-অর্থ, তৈল ও জুতা ক্ষয় করিয়া কোনো রকমে একবার রাজকর্মচারী নিযুক্ত হইতে পারিলেই তাহার চৌদ্দগোষ্ঠিকে আর ভাতের ভাবনা ভাবিতে হয় না। বংশপরম্পরায় এই সুযোগ আসিতেই থাকে।
একদিন প্রাতঃকালে আগের মতই পূর্ব আকাশে সূর্য উদিত হইলো। কিন্তু সহসাই মতিহারের উদ্যানে দলে দলে জড়ো হইবার হিড়িক পড়িয়া গেল। আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হলো-বিনা নোটিশে ৫৪৪জন রাজকর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছে ফারুকিয়া প্রশাসন। এই খবরে চটিয়া গেলেন প্রাসাদেও বাইরে থাকা সিপাহীরা। তাহারা বিদ্রোহ শুরু করিলেন। বিদ্রোহীদের প্রধান সেনাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হইলেন সত্যবাদী যুধিষ্ঠির খ্যাত সোবহানিয়া। সেই আমলে তাহার খুব বেশি নামডাক না থাকিলেও ৫৪৪ রাজকর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করিবার চেষ্টার সংগ্রামে তিনি অসামান্য অবদান রাখিয়াছিলেন। যদিও শেষ অবধি সফল হইতে পারেন নাই তিনি।
ফারুকিয়ার দুধের প্রতি আসক্তি ছিল। রাতের বেলা দুগ্ধ পান না করিলে ঘুম আসিতো না তাহার। নিজের শরীর-মন সতেজ ও লাবণ্যময় রাখতে নির্ভেজাল ও টাটকা দুগ্ধ পাইবার উদ্যোগ লইলেন। হৃষ্টপুষ্ট দেখিয়া অস্ট্রেলিয়ান গাভী কিনিলেন। সরকারি প্রাসাদের ভেতরেই তিনি গাভী পোষার বন্দোবস্ত হইলো। সরকারি বেতনভুক্ত কয়েকজন পায়েক-পেয়াদা গাভীটির খেদমতে আত্মনিয়োগ করিলেন। যখন গাভীন হইলো তখন খুশি আর ধরে না তাহার মনে। দুগ্ধ পানের জন্য আর তর সহেনা তাহার। তাই যতœ-আত্তিও বাড়িয়া গেল। শীতকালে গাভীন গাইকে ঠা-া রোগ হইতে পারে। এমন ভাবিয়া কুসুম কুসুম গরম পানি খাওয়ানোর আদেশ জারি করিলেন। গরম পানির এন্তেজাম করিতে কয়েক লাখ টাকা বিদ্যুৎ খরচ করিলেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। পত্রিকায় খবর বেরোলো। হইচই পড়িলো। কিন্তু কিছুই হইলো না।
তবে ক্ষান্ত হন নি ফারুকিয়া। তাহার দরবারে চা খাওয়ার রেওয়াজ চালু ছিল। চা খাইতে খাইতে যে পরিমাণ বিল ভাউচার জমা পড়িল, তাহা দেখিয়া চক্ষু চড়কগাছে উঠিলো কোষাধ্যক্ষের। পরে চা কা- তদন্তে কমিটিও গঠিত হইলো। কিন্তু কর্তার দুর্নীতি তদন্ত করিবার সাহস রাখে কোন কর্মচারী!
কালের পরিক্রমায় সুদিন হারাইলেন ফারুকিয়া। রাষ্ট্র ক্ষমতায় পালাবদল ঘটিল। মতিহারের আম্রকাননের মঞ্জুরির মিষ্টি সুবাস চর্তুদিকে ছড়াইতে শুরু করিল। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হইলো সোবহানিয়ারও। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শাসনকর্তা নিযুক্ত হইলেন তিনি। ফারুকিয়া আমলের ঘোরতর বিরোধী সোবহানিয়া তাহারই পদাঙ্ক অনুসরণ করিলেন। একই কায়দায় কাটিয়া গেল চারটি বছর। তাহার বিদায়ে যেন সকলেই হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলেন।
ইতোমধ্যে ইস্তেফা দিয়া অন্দরমহলে চলিয়া গেলেন তিনি। সকলেই মনে মনে ভাবিলেন, কাজেকর্মে এন্তেজাম দিতে গিয়া বড়ই পেরেশান হইয়া উঠিয়াছিলেন। তাই স্ত্রী-সন্তানদিগণের সাথে আমোদ-প্রমোদে বাকি জীবন কাটাইয়া দেবেন। সত্যি সত্যি আল্লাহর রাস্তায় মেহনতও শুরু করলেন তিনি। বহুত ফায়দায় আকাঙ্ক্ষায় মাঝে মাঝে খোদার দিদার লাভে নিরুদ্দেশও হতে লাগিলেন।
সিংহাসন খালি। সকলেই ভাবিয়াছিলেন, এইবার বুঝি নূতন পণ্ডিত নিযুক্ত হইবেন এই বিদ্যাপীঠে। স্বরূপ ফিরিবে মতিহারের সবুজপ্রান্তরে। কলকাকলিতে মুখর হইবে বিদ্যার্থীরা। প্রণয়ের স্বপ্ন দেখিবে তরতর করে বেড়ে ওঠা তরুণ-তরুণীরা। কিন্ত সবাইকে তাক লাগাইয়া ইতিহাসের মহানায়ক রুপে আবির্ভাব ঘটিল এক দরবেশের। চতুর্দিকে রব ছড়াইয়া গেল, মহামান্যকে ধোঁকা দিয়া প্রাসাদ দখল করিয়াছেন তিনি। কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, সততার নজরানা হিসেবে স্বপদে ফিরিয়াছেন তিনি। বেশভূষায় দরবেশী রূপ ধরিয়া আবারো অধিপতির আসনে বসিলেন সোবহানিয়া।
দ্বিতীয় মেয়াদে আসিয়া কাহাকেও আর পরোয়া করিলেন না তিনি। দ্বিগুণ তেজে জ্বলিয়া উঠিলেন। রবীন্দ্রভক্ত ছিলেন। তাই কবিগুরুর কাব্যসমগ্র তাহার বুকসেলফে শোভা পাইতে লাগিল। একা একা মুখস্ত করিতে লাগিলেন রবীন্দ্রবাণী। বক্তৃতা-বিবৃতিতেও কেবল তাহাই আওড়াতেন। নিজেকে যুধিষ্ঠির প্রমাণে পুরস্কার ঘোষণাও করিলেন। তাহার কণ্ঠেই মতিহারে দালানে দালানে ধ্বনিতে হইতে লাগিলো কবির বাণী অমর কবিতাখানি-
‘রূপ নারাণের কূলে জেগে উঠিলাম/জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম/ আপনার রূপ/ চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম/সে কখনো করে না বঞ্চনা’।
কবির এই অমৃত বচন মনেপ্রাণে ধারণ করিলেন দরবেশ। কঠিন কঠিন কাজকে সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করিবার যোগ্যতা নিচে নামাইয়া আনিলেন। প্রমাণ করিলেন, একবিংশ শতাব্দীতে শিক্ষা-দীক্ষার ধার ধারার প্রয়োজন কী! বাপজান বা শ্বশুর আব্বা মাথার ওপরে থাকিলে পুত্র, কন্যা, জামাই, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র বা স্ত্রীকূলে থাকা আদরের শ্যালক-শ্যলিকা সবাই পাক্কা যোগ্যতাবান।
দরবেশের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ গেল কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিকট। উচ্চ আদালতে রিট হইলো। তদন্ত কমিটিও গঠন করিলো শিক্ষা মন্ত্রক। নিয়োগের বহন আর না বাড়াইতে নিষেধাজ্ঞা জারি হইলো। কিন্তু কিছুতেই দরবেশের লাগাম টানিয়া ধরা গেল না।
এরপর দরবেশ সোবহানিয়ার বিরুদ্ধে মাথা চাড়া দিলো বিদ্রোহ। তাহার সাম্রাজ্য পতনের প্রত্যয় গ্রহণ করিয়া যে ক'জন অভিযান শুরু করিবার সাহস দেখাইয়াছিলেন, তাদের অগ্রনায়ক টিপু সুলতান। তখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় শত শত সৈন্য জড়ো হইতেন লাউঞ্জে। আর ধোঁয়া ওঠা কড়া লিকারের চায়ের সাথে তাস পেটাইতে পেটাইতে দরবেশের পতনের যুদ্ধে শহীদী তামান্না জাহির করিতেন।
কিন্তু সকালে যখন যুদ্ধের ডাক আসিতো, তখন সিপাহীদের কাহারো কাহারো শরীরে জং ধরিয়া যাইতো। কাহারো শরীরখানা ম্যাজ ম্যাজ করিতো। কেহ মর্নিং ওয়াকে বাহির হইতেন। কেহবা পতœীগণের মায়া ত্যাগ করিয়া আসিতে পারিতেন না। আবার কেহ কেহ টিপুকে ফোনে বলিতেন, ‘ভয় পাইয়েন না। আমরা যুদ্ধের জন্য বুকডাউন দিতে দিতে বেহুঁশ হইয়া পড়িতেছি। যুদ্ধ শুরু হইলেই আমরা সর্বাগ্রে ঝাঁপাইয়া পড়িবো’।
দরবেশের প্রতনের প্রস্তুতির জন্য প্রতিদিন প্যারিস ময়দানে সৈন্যসমাবেশ ঘটাইতেন টিপু সুলতান। কিন্তু মাঠে তাহার সেপাইদের উপস্থিতি ছিল নগণ্য। হাতে গোনা কয়েকজনই পিটি প্যারেডে আসিতেন টিপু সুলতানের ডাকে। তাতে দমিবার পাত্র ছিলেন না টিপু। টিপুর এহেন কা- দেখিয়া আড়ালে আবডালে হাসাহাসি করিতেন আর লুটোপুটি খাইতেন তার শিবিরেরই লোকজন। অনেকেই টিপুকে 'পাগল' বলিয়া আখ্যা দিতেও কুণ্ঠিতবোধ করলেন না।
একদিন প্রাতঃকালে সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হইয়া গেল প্যারিস ময়দানে। দরবেশ সোবহানিয়া তখন প্রাসাদে। উপায়ান্তর না পাইয়া পারিষদবর্গকে তলব করিলেন। বসিলেন মন্ত্রণালয়।
এইদিকে, দরবেশ বাহিনী রণসজ্জিত হইয়া রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান লইলো। এসময় আত্মসমর্পণের আহ্বান জানাইতে হাজির হইলেন লড়াকু টিপু সুলতান। তাহার সাথে হাতেগোনা কয়েকজন সহচর। কিন্তু দরবেশ আত্মসমর্পণে অস্বীকার করায় বাজিয়া উঠিল যুদ্ধের দামামা।
টিপুর লোমশ বুকে গুলি চালাইতে উদ্যত হইলো দরবেশের পোষ্যরা। বুক পাতিয়া দিলেন টিপু। তবে এই অসীম সাহসের পরীক্ষায় পিছু হটিতে বাধ্য হইলো দরবেশের বাহিনী। পরিস্থিতি আঁচ করিয়া রাজ-কর্মচারীদের পাহারায় প্রাসাদ ছাড়িয়া পলাইলেন দরবেশ সোবহানিয়া। ক্ষুদ্র বাহিনী লইয়াই দরবেশকে পরাজিত করলেন টিপু। এই অসীম সাহসিকতা জন্য তিনি সোবহানিয়া রাজ্যে ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’ খেতাব অর্জন করিলেন।
এরপর কিছুদিন গুমোট পরিস্থিতির মধ্য দিয়া চলিয়া গেল। চারিদিকে কানাকানি শুরু হইল। লোকজনের মনে নানা কৌতূহলের উদয় হইল। কে- পরবর্তী শাসনকর্তার আসনে অধিষ্ঠ হইতেছেন-এ নিয়াও নানা গুঞ্জন রটিল। অবশেষে কিছুদিন পর মতিহারের আম্রকাননের মাথার ওপরে নতুন সূর্য উদিত হইল। মহামান্য ফরমান পাঠাইলেন, টিপু সুলতানই পরবর্তী যোগ্য উত্তরাধিকার...
লেখক: সাংবাদিক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক সদস্য ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব
ইমেইল: [email protected]