বিধিনিষেধ: জনমনের প্রতিক্রিয়া



আনিসুর বুলবুল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত দেশ। দানবীয় রূপ নিয়েছে এ মহামারি। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণও ঊর্ধ্বমুখী। শুধু শহর নয়, জেলা-উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। এমন পরিস্থিতিতে সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার দেশজুড়ে বিধিনিষেধ দিয়েছে। চলমান বিধিনিষেধ নিয়ে দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়েছিলাম। বিভিন্ন পেশার মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সরকারি চাকরীজীবি, নাট্যনির্মাতা, ট্রাফিক সার্জেন্ট, ব্যবসায়ী, অ্যাডভোকেট, মুদি দোকানদার, সিকিউরিটি গার্ড, গৃহকর্মীও ছিলেন।

এসব মানুষের কাছে দুটি প্রশ্ন করা হয়েছিল— চলমান বিধিনিষেধ নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া কি এবং সরকারের উদ্দেশে তিনি কিছু বলতে চান কি না। তারা নানা রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেছেন, লকডাউনের বিকল্প হিসাবে দ্রুত সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে। কেউ বলেছেন, টিকার জন্য নিবন্ধন পদ্ধতি সহজ করতে হবে। আবার কেউ সাধারণ জনগণের ঘরে খাবার নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। কেউ অনুরোধ করেছেন প্রতিটি জেলা সদরে করোনা ইউনিটের বেড সংখ্যা দ্বিগুণ করার। কেউ বা মাস্ক পরিধানকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও বলেছেন।

বিধিনিষেধ নিয়ে নানা পেশার মানুষের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো-

 

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ
খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজ, মানিকগঞ্জ।

চলমান বিধিনিষেধ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট নই। বিধিনিষেধ বা লকডাউন যাই বলি না কেন, যতটা কঠোরভাবে কার্যকর করলে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করার কথা তেমনটা হচ্ছে না। সরকারি সংস্থা বিআইডাব্লিউটিসি প্রথম দিন থেকে সরকারি প্রজ্ঞাপন উপেক্ষা করে ফেরিতে যাত্রী, মোটর সাইকেল পারাপার করেছে। অনেক শিল্প কারখানা খুলেছিল। সাধারণ মানুষও নানা অজুহাতে বাইরে এসেছে, বাজারে গেছে। আমার প্রত্যাশা ছিল এবারের লকডাউনটা সত্যি সত্যি কঠোরভাবে পালিত হবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি।

আমার অনুরোধ থাকবে করোনা মোকাবেলায় প্রতিটি জেলা সদরে করোনা ইউনিটের বেড সংখ্যা দ্বিগুণ করা। প্রয়োজনে জেলায় জেলায় ফিল্ড হসপিটাল চালুর প্রস্তুতি রাখা,পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপ্লাই নিশ্চিত করা, যতদ্রুত সম্ভব যত বেশি মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা। এবং বর্তমান পরিস্থিতকে হেলথ ইমার্জেন্সি ঘোষণা করে সমস্ত প্রশাসনিক, রাজনৈতিক,সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি করোনা মোকাবেলায় নিয়োজিত করা। এবং মাস্ক পরিধানকে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

 

কামরুজ্জামান
কামরুজ্জামান

কামরুজ্জামান
অতিরিক্ত উপমহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক
মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, ঢাকা।

চলমান বিধিনিষেধ হলো সরকারের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা, করোনার এই উর্ধ্ব গতি নিয়ন্ত্রণ করার। আগে জীবন পরে জীবিকা এই নীতিতেই সরকার সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে চেষ্টা করছে।

সরকার দ্রুত গতিতে টিকা দেয়া নিশ্চিত করে চলমান লকডাউন ধীরে ধীরে তুলে দিতে পারে। একই সাথে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও নির্দেশাবলি পালন নিশ্চিত করণে আগের মতই সমন্বিত ব্যবস্থা চলমান রাখা জরুরি বলে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি।

 

মাবরুর রশিদ বান্নাহ


 

মাবরুর রশিদ বান্নাহ
তরুণ নাট্যনির্মাতা

আমি সরকারের বিধিনিষেধের সঙ্গে অবশ্যই একমত পোষণ করি। কিন্তু এখানে কিছু কথা আছে। আমি মনে করি, এ বিধিনিষেধগুলো অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। সময়ে সময়ে ছাড় দেওয়া বা আগেও কয়েকবার লকডাউনের কথা বলে সেটা পরিপূর্ণভাবে মেনে না চলা বা চলতে বাধ্য না করতে পারা— এগুলো ব্যর্থতার মধ্যেই পড়ে। তারপর খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়, যারা দিন এনে দিন খায়— সে মানুষগুলোর জন্য ব্যবস্থা করা দরকার। তারা কেমন আছে, তারা ভালো থাকবে কি না।

সরকারের উদ্দেশে অবশ্যই বলতে চাই, যদি লকডাউন ঘোষণা করেন তাহলে ঠিকঠাক মতো পালন করান। যাতে পরবর্তীতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে আবার খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু কোনো কিছুই যেন অর্ধেক না হয় বা পুরোটা শেষ হলো না এমনটা মনে না হয়। এটাই অনুরোধ। এদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। এ কাজ অনেক কঠিন। সরকার যথেষ্ট চেষ্টা করছে। তারা যেন আরেকটু বাড়িয়ে করে।

 

মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা

মো. শফিকুল ইসলাম ভূঞা
সিনিয়র শিক্ষক, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট গার্লস পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ।

লকডাউন দিয়ে এ দেশে করোনা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। দেশের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কারণেই তা অসম্ভব। এই ঘনবসতির দেশে দূরত্ব বজায় রেখে চলা অসম্ভব। বেশিরভাগ কায়িকশ্রমজীবী মানুষের পক্ষে মাস্ক পরে থাকাও অসম্ভব। আর কাজ বন্ধ রেখে মাসের পর মাস ঘরবন্দি থাকাও অসম্ভব। লকডাউনের বিকল্প হিসাবে দ্রুত সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে। টিকা যোগাড়ের সাথে সাথে টিকাদান কার্যক্রমেও গতি বাড়াতে হবে। বর্তমানে টিকা পেতে অনলাইনে নিবন্ধনের যে উচ্চাভিলাসী পদ্ধতি চালু আছে সেভাবে চললে টিকা মেয়াদোত্তীর্ণ হবে কিন্তু মানুষ টিকা বঞ্চিতই থেকে যাবে।

টিকার জন্য নিবন্ধন পদ্ধতি সহজ করতে হবে। টিকা কেন্দ্রে টিকা কার্ড থাকবে, সেখানেই নিবন্ধন হবে। নিবন্ধনের জন্য প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা যেতে পারে। প্রত্যেক ইউনিয়নে গণটিকাকেন্দ্র স্থাপন করে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সেই সামর্থ্য আছে। টিকার নিবন্ধনে জাতীয় পরিচয়পত্রের বিকল্প রাখতে হবে।

 

মুহাম্মদ সোহরাব হুসাইন

মুহাম্মদ সোহরাব হুসাইন
পু‌লিশ সা‌র্জেন্ট, ট্রা‌ফিক তেজগাঁও বিভাগ, ডিএম‌পি।

নিঃসন্দে‌হে সরকার সবসময় জনকল‌্যা‌ণেই সকল স্বিদ্ধান্ত নি‌য়ে থা‌কেন। এরই ধারাব‌া‌হিকতায় জনগণকে স্বাস্থ‌‌্যবি‌ধি মে‌নে চলায় অভ‌্যস্থ করা ও ভ‌বিষ‌্যৎ গণ‌বিপর্যয় নিয়ন্ত্রণের জন‌্য চলমান এ বি‌ধি‌নি‌ষেধ দি‌য়ে‌ছেন। কিন্তু এ বি‌ধি নি‌ষে‌ধের ফ‌লে দে‌শের সাম‌গ্রিক অর্থনী‌তির ওপর এবং সাধারণ জনগ‌ণের জী‌বিকা নির্বা‌হে কি ধর‌নের, কতটা বি‌রুপ প্রভাব পড়তে পা‌রে সে বিষ‌য়ে আরো চুল‌চেরা হি‌সেব করা উচিৎ।

সরকার ঘো‌ষিত লকডাউন বাস্তাবায়‌নে সম্মুখ স‌ারির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকা‌রী বা‌হিনীর সদস‌্য হি‌সে‌বে চেক‌পো‌স্টে প্রতি‌দিন প্রা‌ন্তিক মানুষজ‌নের ক্রিয়া-প্রতি‌ক্রিয়া অভিমত থে‌কে এটা ম‌নে হয় যে, মানুষজন জী‌বিকা নির্বাহ ক‌রে বেঁচে থাক‌তে চায়। যেটা চলমান বি‌ধি‌নি‌ষে‌ধের ফ‌লে বৃহত্তর জন‌গো‌ষ্ঠী কর‌তে পার‌ছে না। সব‌চে‌য়ে বে‌শি বিপ‌দে প‌ড়ে‌ছে যারা কা‌রো কাছে হাত পাততে পার‌ছে না আবার নি‌জে উপার্জনও কর‌তে পার‌ছে না। আমা‌দের সমা‌জে এ শ্রেণির লোকজন অনেক বে‌শি। এমন প‌রি‌স্থি‌তে সরকা‌রের উচিৎ লকডাউনের বিকল্প ‌গণটিকা কর্মসূ‌চি‌ জোরদার করা। যত দ্রুত সম্ভব বি‌ধিনি‌ষেধ শিথিল ক‌রে দি‌য়ে জীবন যাত্রায় কিছুটা স্বাভা‌বিক অবস্থা ফি‌রি‌য়ে আনার চেষ্টা করা।

 

মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জসিম

মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম জসিম
অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, মানিকগঞ্জ।

এভাবে একের পর এক লকডাউন সমস্যার সমাধান নয়। আমাদের মত গরিব দেশে লকডাউন কার্যকর করা অনেক কঠিন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে খাদ্যের ব্যবস্থা না করে কখনো লকডাউন ফলপ্রসূ হবে না, তাই লকডাউনের বিকল্প হিসেবে সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে এবং পার্সোনাল দূরত্ব বজায় রাখতে হবে পরিশেষে বলছি সকল মানুষকে ভ্যাকসিন এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

লকডাউন যদি দিতেই হয় তার আগে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ৭/১৪ দিনের খাওয়ার ব্যবস্থা করবেন তার পরই লকডাউন দিবেন। সকল নাগরিককে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং সব কিছুই স্বাভাবিক করে দিতে হবে।

 

সাফায়েত হোসেন

সাফায়েত হোসেন
প্রিন্সিপাল, স্কাইলার্স মডেল স্কুল, মাটিকাটা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল এবং ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। কারও ঘরে খাবার আছে, কারও ঘরে খাবার নেই। এ ধরনের বিধিনিষেধ দিয়ে সরকার এক শ্রেণির জনগণকে পর্যায়ক্রমে দারিদ্র্য সীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। তাই এ ধরনের বিধিনিষেধ আমাদের দেশে কার্যকরী পদক্ষেপ হবে বলে আমার মনে হয় না। এবং জনগণ বাধ্য হয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণাকে প্রাধান্য দিচ্ছে।

সরকারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই- আগে সাধারণ জনগণের ঘরে খাবার নিশ্চিত করুন। প্রয়োজনে অন্য খাত থেকে অর্থ এনে স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করুন এবং প্রত্যেকের জন্য টিকার ব্যবস্থা করুন। তারপর লকডাউনের পরিবর্তে কার্ফিউ জারি করুন।

 

সাজযাদ হোসেন শোয়েব

সাজযাদ হোসেন শোয়েব
ডিজিটাল মিডিয়া ও মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ

এরকম জোরদার লকডাউনে ঢাকার বাইরে নিজ নিজ এলাকায় যত শ্রমিক ও বাংলাদেশি অবস্থান করছেন সরকার চাইলে প্রত্যেক জেলায় জেলায় নগরায়ন ও কর্মসংস্থান করে দিতে পারে। এতে করে ঢাকা শহরের ওপরে চাপ কমবে এবং উপজেলা শহরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে।

যে জেলার যে মানুষ সে সেই জেলাতেই কাজ করতে পারবেন। ইন্ডাস্ট্রিগুলোও ঢাকার বাইরে কর্মসংস্থান গড়তে পারবে ও সেটাপ করতে পারবে। ঢাকা বর্তমানে যে ফাঁকা অবস্থাতে আছে সেরকম ভাবে থাকলে ঢাকার ওপরে বহিরাগতের চাপ কমবে ও জেলায় জেলায় তারা বিভিন্ন কর্মে যোগ দিতে পারলে তারাও বেঁচে থাকতে পারবে।

 

আনোয়ার হোসেন মিয়া

আনোয়ার হোসেন মিয়া
সুলতানার স্বপ্ন জেনারেল স্টোর, বাগানবাড়ি, উত্তর ভাষাণটেক।

চলমান বিধিনিষেধ মোটেও কার্যকর একটি পদ্ধতি না। এটি কার্যকর হচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছার যে অভাব তা আমি বলবো না। আসলে প্রক্রিয়াটাই এরকম যে মানুষকে ঘরে ধরে রাখা যাচ্ছে না। মানুষ ঠিকই বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, মুদি ব্যবসায়ী। জনগণ জানে ঠিকই যে তিনটা পর্যন্ত মুদি দোকান খোলা থাকবে। কিন্তু আমার দিনের বেলার চেয়ে রাতেই বেশি কাস্টমার হয়। আমি কোনো না কোনোভাবে বিধিনিষেধ ভঙ্গ করে দোকান খোলা রাখি। কারণ একটাই কাস্টমার যদি না আসতো আমি নিজেই দোকান খুলতাম না।

সরকারের উদ্দেশে অনেক কিছুই বলতে চাই। তারমধ্যে করোনা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হবে যে বর্তমান পদ্ধতি লকডাউন আসলে গতানুগতিক হয়ে গেছে। সরকারকে নতুন করে নতুন কিছু ভাবতে হবে। যেটা শতভাগ কার্যকর হয়।

 

আশরাফুল ইসলাম

আশরাফুল ইসলাম
সিকিউরিটি গার্ড, ইউনাইটেড হোমস্, বাগানবাড়ি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।

চলমান বিধিনিষেধে আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো খুব কষ্টে আছে। পরিবহন বন্ধ থাকায় তারা সঠিকভাবে উপার্জন করতে পারছে না। তাই তারা খুব কষ্টে জীবন যাপন করছে। এর জন্য বিধিনিষেধ অনেকেই মানতে চাচ্ছে না।

সরকারের উদ্দেশে একটা কথায় বলতে চাই। গরিব মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে সীমিত আকারে জেলা পর্যায়ে পরিবহনগুলো চলাচল করতে দেওয়া হয়। আর গরিবদের খাদ্যদ্রব্য যেনো সঠিকভাবে পায়। নেতারা যেনো গরিবদের খাদ্যদ্রব্যগুলো নিজেরাই খেয়ে না ফেলে সে দিকে খেয়াল রাখতে বলছি।

 

নাসিমা আক্তার

নাসিমা আক্তার
গৃহকর্মী, মোহনগঞ্জ বস্তি, মাটিকাটা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট।

আমরা তো খুব কষ্টে আছি। আমার মা যে বাসায় ছুটা কাজ করত এখন আর করতে পারছে না। করোনার কারণে তারা বাদ দিয়ে দিছে। আমি একটা বাসায় কাজ করি। সে বাসাতেই থাকি। আমাকে বাদ দেয় নাই কিন্তু আমাকে তো আর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। বলে ভাইরাস নিয়া আসবা। আমাদের বস্তির বাচ্চাকাচ্চা অসুস্থ ওষুধ নিতে পারতেছে না। কারো কাছে তো টাকা নাই। যারা কাজ করতো বাইরে কেউ করতে পারতেছে না। খুবই কষ্ট।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;