প্রশান্ত পশ্চিম
পর্ব-১
তার্কিশ এয়ারে টি কে সেভেন টু থ্রি ফ্লাইট ঢাকা ছাড়বে রাত দশটা পাঁচে। চেক ইন শেষ সাড়ে নয়টায়। আমি আকাশসমান উদ্বেগ নিয়ে বসে আছি খিলক্ষেত ফ্লাইওভারের দশচক্করের জ্যামে। জীবনের এন্তার উড়ালে জাহাজ ফেল হওয়ার ঘটনা মনে পড়ে না। তা আজ কপালে জুটছে- ভাবনার মধ্যে বিশাল ঝঞ্ঝাটময় নগর ও পৃথিবীতে মাথা শান্ত রাখতে আমি কথাসাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন এর ‘আড়িয়াল খাঁ’র গল্পের ভেতরে ঢুকে যেতে চাচ্ছি। উপন্যাসটি বই আকারে বের না হলেও দৈনিকের ঈদসখ্যা থেকে বিশেষ কেতায় স্ট্যাপল করে হাতবাগে নিয়েছি। ভিন্নগাড়িতে লাগেজ এয়ারপোর্টে পৌঁছেছে। এয়ারপোর্টের গেট ‘দ্রুত আসুন’ বলে বার বার ফোন আসছে। ফোনের তাড়া কানে না তুলে এ্যাবাউট টার্নে বাড়ির পথ ধরার কথা ভেবে রেখে ‘আড়িয়াল খাঁ’ নিয়েই মেতে আছি। কিছুক্ষণ পর যার দূরগামী ফ্লাইট ছেড়ে যাবে, সেই লোক গাড়িতে বসে উপন্যাস পড়ছে- এর চেয়ে শান্তমাথার চিত্রকল্প বোধ হয় পৃথিবীতে নেই।
কিছুক্ষণ পর নিজেকে আবিষ্কার করি জলি আর তুসুর সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি ১১ নম্বর বোর্ডিং গেটের অভিমুখে। বোর্ডিংয়ের ঘন ঘন অ্যানাউন্সে এতোটা উতলা আছি যে পকেটে মেম্বারশিপের কার্ড থাকতেও বিমানবন্দরে সেবায় উন্মুখ লাউঞ্জগুলোর আতিথ্য নিতে পারিনি। যারা তিন চার ঘণ্টা আগে এসে বিমানবন্দরের সব প্রক্রিয়া সাঙ্গ করেছে, তাদের সঙ্গেই প্লেনে উঠতে পারার শেষ হাসি হাসছি।
কিছুক্ষণ আগে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেখি নিকটাত্মীয়গণ লাগেজ নামিয়ে ‘মিট এ্যান্ড গ্রিট’ এর ইউনিফর্মধারী দুই কর্মীর কাছে তুলে দিয়ে অপেক্ষমান আছে। ওয়াকিটকি হাতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তা আমার নাম ধরে খুঁজে নিয়ে ভেতরে নিয়ে গেল। বিজনেস ক্লাসের কাউন্টার তখনও খোলা। ইকোনমির গরিবী যাত্রী হয়েও উঁচুশ্রেণীর কাউন্টারে চেক ইন হলো চোখের পলকে। বোর্ডিং পাসের প্রিন্ট হাতে আসতে না আসতেই মিটগ্রিট কর্মীরা তিনজনের ইমিগ্রেশন ফরম পূরণ করে ফেলেছে। কোভিড টেস্টের সনদ ভেরিফাই করে নিয়ে এসেছে এয়ারপোর্ট হেলথ অফিসারের কাছ থেকে। ইমিগ্রেশনস্তরে ঢুকিয়ে দিয়ে বিদায় হয়েছে আর্মড পুলিশের এসআই। পুলিশের সিনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে পাচ্ছি এই জামাই আদর। ভাবি; কোন দুর্মুখ বলে পুলিশ জনগণের বন্ধু না।
পৃথিবীর সব প্রান্তে চলাফেরা করি মায়ের দোয়াকে সঙ্গী করে। টেকঅফের আগে ডিভাইস বন্ধ করার ঘোষণা দিচ্ছে যখন টার্কিশ এয়ারের লাস্যময়ী তুর্কি সুন্দরী এয়ারহোস্টেজ, কাউকে তোয়াক্কা না করে আমি তখন কানে মোবাইল চেপে উচ্চস্বরে বলে যাচ্ছি-
- ‘হ্যালো, হ্যালো, মা, মা, জেগে আছো?’
দুই.
ভোর সাড়ে তিনটায় পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে দশহাজারে নেমে প্লেন দুই চক্কর দিতেই উইন্ডো সিটে বসা জলি স্বচ্ছ জানালায় আঙুল ঠেকিয়ে ইশারা করলো- ‘ইস্তাম্বুল’।
বললাম, হুমম, ‘সিটি অব ফ্রেগ্রেন্স’। সুগন্ধিনগরী।
মনে ভেসে উঠলো ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের সৌন্দর্যমুগ্ধ দিগ্বিজয়ী সুলতান সোলায়মান আর তাঁর স্ত্রী হুররম সুলতানের কথা। অর্ধসহস্র বছর আগের সুলতান সোলায়মান ও হুরমমকে দেখিনি বলে তাঁদের চেহারা মনে এলো না। টিভি সিরিজ সুলতান সোলায়মান এর নায়ক খালিদ এরগেঞ্চ ও নায়িকা মারিয়াম উজারলি’র সুন্দর মুখশ্রী যখন মনের পর্দায় ভাসছে, তখন চোখের পর্দায় উদ্ভাসিত রাতের ইস্তাম্বুল, এর হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করা বসফরাসপ্রণালী আর সবকিছুকে ছাপিয়ে বসফরাসের আভরণ আলোকসজ্জিত তিনটি সেতু। কৃষ্ণসমুদ্র আর মারমারাসাগরের বিচ্ছিন্নতার বেদনা থেকে মুক্তি দিয়ে মিলনের আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে বসফরাস। মিলনের সেতুবন্ধন হয়েছে যুগলসমুদ্রের। এই সাগরদুহিতার ওপর নির্মিত সেতু কাঠামোয় উদ্ভাসিত বহুবর্ণিল আলোকমারা। সেদিকে চোখ পড়তেই জানালার দিকে ইশারা করে আবারও জলির উচ্ছ্বাস-‘ওই ওই’।
ভেতরের আলোআঁধারি পরিবেশে আয়েল আসনে গা এলিয়ে বসেছি। হাঁটুতে বার বার গুতো দিয়ে যাওয়া আসা করছে দীর্ঘাঙ্গিণী তুর্কিবালা- মধ্যরাতের আগে যে পরম যত্নে খানাপিনায় উদর আর লাবণ্যময় নজরকাড়া চেহারায় ভরে দিয়েছে চোখ। এখন বসফরাসের আলোর সেতুতে অভিভূত চোখ রাখতে গিয়ে আমি জলির দিকে বেশিই ঝুঁকে পড়ি। পরিচিতস্পর্শ মনে মাদকতা আনে।
টিভি সিরিজের লাস্যময়ী হুররমের রূপমাধুর্য, দীর্ঘাঙ্গিনী তুর্কিবালার সুগন্ধিময় যাতায়াত, দুষ্টুমনের গুতো আর বাসে বসা জলির পরিচিতস্পর্শে আমি মুগ্ধতার আবেশে জড়াই। কৈশোরউত্তীর্ণ পুত্র তুসু অন্য আসনে ঘুমঘোরে, রাতের প্রান্তবেলায় জোৎস্নার আলো ম্রিয়মান, আমাদের নির্ঘুম রাত্রির ভ্রমণক্লান্তিকে এ সময় আনন্দে ভরে দিচ্ছে ইস্তাম্বুলের সেতুসমূহের উজ্জ্বল উদ্ভাসন। চোখের পর্দায় বর্ণিল প্রশান্তি ঢালছে বসফরাস।