আফগাননামা
এই ছবিটি আমি তুলেছিলাম ২০০৯ সালে। মদিনায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র মসজিদের সম্মুখস্থ মার্কেটের বারান্দায়। একদল আফগান তীর্থযাত্রী সারিবদ্ধ বসে আছেন দেখে ছবিটি ধারণ করি।
তখন হজ্জ বা ওমরাহ করতে অত বিধি-নিষেধ ছিল না। হোটেল বুকিং আবশ্যিক ছিল না। ভিসা, টিকেট করে হোটেলে বা চেনাজানা কারও বাড়িতে থেকে দিব্যি এক মাস কাটিয়ে দেওয়া যেতো।
আফগানরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতেন অদ্ভুতভাবে। মস্ত পাগড়ি, আজানুলম্বিত জুব্বা বা আলখাল্লা, বিরাট বোচকা নিয়ে তাদের ছিল চলমান-ভাসমান অবস্থান। মার্কেটের বারান্দায়, মসজিদের চত্বরে, সামান্য একটু জায়গা পেলেই তাদের আর কিছু লাগতো না। জগৎ-সংসার ভেসে গেলেও তারা কুণ্ডলী ঘুমে থাকতেন বিভোর। মাঝে মধ্যে মসজিদের বিশালাকার হাম্মামে গোসল ও অন্যান্য নৈমিত্তিক কাজ অবলীলায় সেরে নিতেন তারা।
আফগানদের দেখেছি কথা খুবই কম বলেন। নিজেদের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করেন তারা। সামান্য পোশাক-পরিচ্ছদ আর স্বল্পাহারে কঠোর কষ্ট করে আরবের তপ্ত মরুর রৌদ্র ও লু হাওয়ায় বেশ মানিয়ে নিতেন তারা।
চাক্ষুষ একদল আফগান দেখার আগে তাদের সম্পর্কে জেনেছি ইতিহাসের বীর শেরশাহের মাধ্যমে, যিনি সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত ও বিতারিত করে মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে একটি সময়কাল নিজের কব্জায় রেখেছিলেন। জীবৎকালে তিনি হুমায়ুনকে দিল্লির মসনদের ত্রিসীমায় ঘেঁষতে দেন নি।
দিল্লি তথা বিশাল ভারতের মতো বাংলার ইতিহাসের একটি পর্যায়ও ছিল আফগান-পাঠানদের শাসনাসীন। উপমহাদেশ বিভাজনের সময় ঔপনিবেশিক ইংরেজরা বাংলা, পাঞ্জাবের মতো আফগান ভূমিকেও খণ্ডিত করে। পেশোয়ার কেন্দ্রিক পাকিস্তানের খাইবার-পাকতুনখাওয়া অঞ্চলে এখনও পাঠান-পশতুন প্রাধান্য বিরাজমান।
বাংলা সাহিত্যে আফগান, পাঠান প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলীর মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প আর সৈয়দ মুজতবা আলীর ভ্রমণ কাহিনীতে আফগান চরিত্র অম্লান। 'কাবুলিওয়ালা’ ছোটগল্প বোধহয় পড়া হয়েছে প্রায়-প্রতিটি বাঙালির। কলকাতার সিনেমাতে ছবি বিশ্বাস অভিনীত রহমতের মধ্যে দিয়ে আমাদের আফগান মানসের অভিজ্ঞান, নিজ-কন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন সুদূর হিন্দুস্তানে কন্যাসম এক বালিকার মমতায় মিশে যাওয়া এক মানুষকে চিনেছিলাম।
আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আমার কিশোর মনে বিশেষ ধারণা তৈরি হয়নি। আফগানিস্থান ভূগোলের ঠিক কোথায়, সেটা জানতে আরও সময় লেগেছে। পরে, ঢাকা বা চট্টগ্রামে কোনও আফগানির দেখা না পেলেও একজনকে পেয়েছিলাম প্রায়-বাঙালির মতোই নৈকট্যে। ঢাকার দৈনিক বাংলা মোড়ে অধুনালুপ্ত 'হারুন ডায়েরি'র হারুন ভাই। একদা নায়ক ছিলেন। বলিউড নায়ক দীলিপ কুমার তথা ইউসুফ খানের চাচাতো ভাই। বাংলাদেশে স্থায়ী হয়ে প্রায় -বাঙালি হয়ে গেছেন তিনি। তবে কলকাতায় প্রচুর কাবুলীওয়ালা বেশের আফগানি দেখতে পেয়েছি। বহু অভিবাসী আফগান সেখানে বসবাস করলেও নিজের কৃষ্টি, ঐতিহ্য ত্যাগ করেন নি। আর কলকাতার পাড়ার মোড়ে মোড়ে 'আলু-কাবলি' এবং ধর্মতলায় 'আফগানি'র স্বাদ অনেক পেয়েছি।
তারপর তো আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ গত ৪২ বছর ধরে মিডিয়ায় জীবন্ত। সোভিয়েত আগ্রাসন, সম্মিলিত মুজাহিদিন বাহিনী, তালেবানদের উত্থান, আমেরিকান ও মিত্রদের সৈন্য সমাবেশ, পুনরায় তালেবানদের ক্ষমতা দখলে আফগানিস্তান জর্জরিত। এক কালে আফগানিস্তান ছিল নিজেদের শাসিত সাম্রাজ্যের অধীন। কালে কালে রাজপাট বদলে বৌদ্ধ এবং অবশেষে ইসলাম এসেছে সেদেশে। তবে হিন্দুকুশের পাহাড়, উপত্যকার দেশটির প্রত্যেকটি পালাবদল রক্তরঞ্জিত।
কাবুলনামা চন্দ্রগুপ্ত থেকে কনিষ্ক, তৈমুর, মুঘল থেকে অধুনা আহমেদ শাহ মাসুদ বা তালেবান, বিভিন্ন রোমহর্ষক বীরগাথায় গাঁথা। তথাপি বঞ্চিত বা দুর্বল দেশটি। নানা শক্তির চারণভূমি। দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার কেন্দ্রে কৌশলগত অবস্থান, খনিজ পদার্থের সম্ভার এবং সর্বোপরি কর্মঠ জনগোষ্ঠী আফগানদের দুর্দশার যেন শেষ নেই! এদিকে নানা অস্থিরতায় মাথাপিছু আয়ে পৃথিবীর দরিদ্রতমদের মধ্যে অন্যতম আফগানিস্তান।
শেষ একশো বছরে ব্রিটেন, রাশিয়া, আমেরিকা— এ রকম কোনও এক দেশের সেনার হাতে মার খেয়ে এবং তাদের পাল্টা মার দিয়ে, তার পর আবার লড়াই শুরু করতে হয়েছে অন্য এক শক্তির সঙ্গে। বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো সুযোগ মতো লেজ গুটিয়ে বিদায় নিলেও আফগানরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। সঙ্কট ও সংঘাতের ঘূর্ণাবর্ত থেকে মুক্তি পাচ্ছে না।
কেউ জানে না, আফগানদের দুর্ভাগ্যের অবসান কবে হবে?