বিড়ালের মৃত্যুতে আর্দ্র হৃদয়
স্তন্যপায়ীদের মধ্যে পোষা প্রাণী হিসেবে বিড়ালের কদর সবচেয়ে বেশি। বিড়াল শান্তশিষ্ট প্রাণী, তার মেজাজ-মর্জিও অন্যসব পোষা প্রাণী থেকে আলাদা। বিড়ালের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ যুগ যুগ ধরে অব্যাহত। পাহাড় ও অরণ্যের মেলবন্ধনের অনিন্দ্য ভূমিতট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক এলাকায় বহুমাত্রিক প্রাণবৈচিত্র্যে অভাব নেই। অবাধে ঘুরে বেড়ায় নানা বন্য প্রাণী। বিভিন্ন বাড়িতে রয়েছে পোষা প্রাণীও। যার মধ্যে বিড়ালের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
মানব সমাজে ঠিক কবে থেকে বিড়ালকে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখার প্রচলন শুরু হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে শুরু করে নবী করিম (সা.)-এর জামানায় অনেকেই বিড়াল পুষতেন। এমনকি সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী (৫৩৭৫টি হাদিস তিনি বর্ণনা করেছেন) সাহাবি হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-কে 'বিড়ালের পিতা' বলে ডেকেছেন স্বয়ং নবী করিম (সা.)। তিনিও বিশ্ববাসীর কাছে আবু হুরায়রা বা 'বিড়ালের পিতা' নামে পরিচিত, যদিও তার প্রকৃত নাম আবদুর রহমান ইবনে সাখর।
আবু হুরায়রা বা 'বিড়ালের বাবা' নামটির পেছনে একটি মজার কাহিনী রয়েছে। একদিন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) জামার আস্তিনের নিচে একটি বিড়ালছানা নিয়ে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হন। সে সময় বিড়ালটি হঠাৎ করে সবার সামনে বেরিয়ে পড়ল। এ অবস্থা দেখে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে রসিকতা করে, ‘হে বিড়ালের পিতা’ বলে সম্বোধন করলেন। এরপর থেকে তিনি আবু হুরায়রা নামে খ্যাতি লাভ করেন। আর সেদিন থেকে তিনি নিজেকে আবু হুরায়রা নামেই পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন।
উপরোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যায়, ইসলামে বিড়াল পালনে কোনো বাধা নেই। যারা মসজিদের হারাম কিংবা মসজিদে নববিতে যান, তারা সেখানে প্রচুর বিড়াল ছোটাছুটি করতে দেখেন। আগত মুসল্লিরাও তাদের পানি কিংবা খাবার দিয়ে থাকেন।
অনেকেই জানতে চান, বিড়াল পালা কি জায়েজ? এর উত্তরে ইসলামি স্কলাররা বলেছেন, হ্যাঁ, বিড়াল পালা বৈধ। তবে তাকে কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া যাবে না। বিড়াল পুষতে চাইলে অবশ্যই তাকে পর্যাপ্ত খাদ্য-পানীয় সরবরাহ করতে হবে। বিড়ালের প্রতি যথাযথ দয়া-অনুগ্রহ দেখাতে হবে। বিড়ালকে কোনো ধরনের কষ্ট দেওয়া যাবে না। শুধু বিড়াল নয় কোনো প্রাণীর ওপর কোনো ধরনের অমানবিক নির্যাতন কিংবা অবিচার করলে গোনাহগার হতে হবে।
প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে রয়েছে যে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জনৈক মহিলাকে বিড়ালের প্রতি অমানবিক আচরণের কারণে আজাব দেওয়া হয়। সে বিড়ালটি বন্দি করে রাখে, এ অবস্থায় বিড়ালটি মারা যায়। এমনকি বন্দি করে রেখে পানাহার করায়নি এবং ছেড়েও দেয়নি, যাতে করে বিড়ালটি জমিনের পোকা-মাকড় খেয়ে বাঁচতে পারে।’ (সহিহ মুসলিম : ৫৭৪৫)
বর্ণিত হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেছেন, ‘এ হাদিস থেকে বিড়াল পালা ও বিড়ালকে বেঁধে রাখা জায়েজ বলে প্রমাণিত হয়, যদি তাকে খানাপিনা দেওয়ার ব্যাপারে ত্রুটি না করা হয়।’ (ফাতহুল বারি : ৬/৪১২)
এ ছাড়া আরও কিছু হাদিস রয়েছে, যা থেকে বিড়াল পালন জায়েজ প্রমাণিত হয়। সুতরাং পৃথিবীতে বিড়ালসহ আল্লাহর যত সৃষ্টি রয়েছে, সবকিছুর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করতে হবে। কেননা, নবী করিম (সা.) নিজেও তা করেছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অজু করতেন তখন নিজের অজুর পাত্র থেকে বিড়ালকে পানি পান করাতেন। এ সম্পর্কে হাদিস বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘দয়াবানদের ওপর দয়াময় আল্লাহও দয়া করেন। তোমরা জমিনের অধিবাসীদের প্রতি দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ : ৪৯৪১)
দুনিয়ায় আল্লাহর যত সৃষ্টি রয়েছে সবকিছুর প্রতি দয়া অনুগ্রহ করতে হবে। বিশেষ করে, মানুষের পরম বন্ধু বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা বা মমত্ববোধ দেখাতে হবে। সমাজের অনেকেই আছে, যারা বিড়াল দেখলে তাড়িয়ে দেয়, অকারণে পেটায়, গায়ে গরম পানি ছুড়ে মারে এসব পাপের কাজ; যা মোটেও কাম্য নয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বিড়ালের প্রতি স্নেহ ও প্রেমের অম্লান দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। একটি বিড়ালের আকস্মিক মৃত্যুতে মানবিক বেদনার ধারাও লক্ষ্য করা গেছে। রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের বরিষ্ঠ অধ্যাপক, সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ-এর প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ড. ভূঁইয়া মো. মনোয়ার কবির জানান, 'আমাদের বাসার বিড়ালটা আজ (শুক্রবার) বেলা পৌনে বারোটার দিকে মারা গিয়েছে। তাকে আমি ডাকতাম "ঘুষুমা" বলে, আমার মেয়ে ডাকত "পেঙ্গু" আর আমার স্ত্রী, আনোয়ারা ম্যাডাম, "এনজো" বলে ডাকতেন। সে একটা হুলো বিড়াল ছিল। তার বয়স হয়েছিল মাত্র দশ মাস।'
তিনি জানান, 'আমাদের ক্যাম্পাসস্থ বাসায় প্রথমে বিড়ালটা মায়ের আশ্রয়স্থল হয়। এরপর এই বাসাতেই বাচ্চাটার জন্ম হয়। বাসাতেই বড় হয়। ম্যাডামের উদ্যোগে বাসার সবার আদরে, যত্নে, ভালোবাসায়, বাসার একজন সদস্য হিসাবে। আমাদের সবার প্রতি তার দাবী ছিল আলাদা।'
শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) সকালে রুটিন অনুযায়ী আমি তাকে দুধ ও টোস্ট বিস্কুট খেতে দেই। উল্লেখ্য, ও শীতে আমার কম্বলের নীচে ঘুমাত।
তারপর রুটিনমতোই বাসা থেকে বের হয়ে তিন রাত পরে ভয়ংকর অসুস্থ ও কাহিল অবস্থায় রাত পৌনে একটার দিকে বাসার দরজায় বসে কান্না করতে থাকে। এটা অস্বাভাবিক রকমের ব্যতিক্রম ছিল। একটানা এতদিন কখনো সে বাইরে থাকেনি। দিনে চার-পাঁচবার সে বাসায় আসতো, খেতো। তো, ওর কান্না শুনে ম্যাডাম ওকে ভেতরে নিয়ে আসেন। অবশেষে সে বাসায় এলো বলে মনে স্বস্তি পেলেও তার পরিস্থিতি দেখে ভয় পেলাম, কষ্ট হলো। বাঁচবে তো! এমন অলক্ষুণে চিন্তা মাথায় এসে গেল। আমি নিজেই তখন অনেক অসুস্থ। ভয় বেড়ে গেল যখন দেখলাম সে ঠিকমত হাঁটতে পারছেনা, সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। কিছুই খাচ্ছিলনা দেখে মনের ভিতরটা আৎকে উঠল। তবুও আশায় বুক বেঁধে রইলাম। কলিগ/ক্যাম্পাসের ভাতিজা পিলু (প্রাণীবিদ্যা বিভাগের আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী)'র সাথে পরামর্শক্রমে হাটহাজারীতে প্রাণিসম্পদ অফিসে ডাক্তার দিয়ে দেখানো হলো। কিন্তু সবার ভালোবাসা নিয়ে, সবাইকে ভালোবাসায় কাঁদিয়ে আমাদের "ঘুষুমা"/"পেঙ্গু"/"এনজো" এই নিষ্ঠুর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। জানান প্রফেসর কবির।
বিড়ালের মৃত্যুতে বাড়ির কারোই মন ভালো নেই। যারা বিড়ালটিকে দেখেছেন, তারা সবাই মর্মাহত। ঘটনাটি যারা শুনেছেন, তারাও বেদনাহত। অবলা প্রাণী ও গৃহপালিত পশুর প্রতি মমত্বের চেতনায় দীপ্ত এই ঘটনা ক্যাম্পাস জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। একটি বিড়ালের মৃত্যুতে আর্দ্র হয়েছে বহু হৃদয়।