বোহেমিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের স্বর্গীয় শহর প্রাগ



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
বোহেমিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের স্বর্গীয় শহর প্রাগ

বোহেমিয়া চেক প্রজাতন্ত্রের স্বর্গীয় শহর প্রাগ

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রাচীন বোহেমিয়া রাজ্য বা আজকের চেক প্রজাতন্ত্রে ভ্রমণ ট্রিপে ইউরোপের পশ্চিম থেকে পূর্বে  ভিয়েনা, ব্রুনো হয়ে স্বর্গীয় শহর প্রাগে প্রবেশের রোমাঞ্চকর অনুভূতির তুলনা হয় না। তারপর "নাইট ওয়াক ইন দ্যা সিটি অফ প্রাগ" মানেই লাইফটাইম মেমোরি। তবে, প্রাগে নামেই রাত, বাস্তবে খুঁজতে হবে "কোথায় রাত ?" রাতের যেন পড়ন্ত বিকেল।  আকাশে তখনো কটকটে রোদ। বাতাসে বসন্তের রেশ।

পশ্চিম ইউরোপ যেমন জার্মানিক, পূর্ব ইউরোপের প্রাগ শহরে তেমনই প্রধানত স্লাভিক ট্রাইবদের বাস। চেক ভাষায় প্রাগের নাম প্রাহা। যার অর্থ হল ‘ford’ বা ‘rapid’। আক্ষরিক অর্থে ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ওপর দিয়ে পেরোতে হয় এই অঞ্চল যেখানে নদীর গভীরতা অত্যন্ত কম। মানুষ আর ঘোড়াও সেই তিরতির করে বয়ে চলা অগভীর নদীর মধ্যে দিয়ে অনায়াসে এককালে পেরিয়ে চলত। এখন সেখানে ছোট্ট ব্রিজ হয়েছে। এই হলো প্রাহা নামটির উৎসমূল।

দেশ হিসেবে চেক প্রজাতন্ত্র কিংবদন্তির ভাণ্ডার। বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী স্লেভিক রাজকন্যা লিবিউসে অসাধারণ ভবিষ্যদ্বাণী করতেন । পাহাড়ের মাথায় তিনি আর তার স্বামী রাজপুত্র প্রেমিস্ল শান্তিপূর্ণভাবে রাজ্য শাসন করতেন। একদিন পাহাড়ের মাথায় উঠে, ভ্লাতাভা নদীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে তিনি বললেন, অদূর ভবিষ্যতে এই শহর হয়ে উঠবে পূর্ব ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শহর। খ্যাতির শিখরে পৌঁছবে তার শিল্প-কলা-কৃষ্টির উৎকর্ষতায়। শাসন বানালেন একটি বিশাল দুর্গ বানিয়ে চলেছিল। রাণীও বললেন, ওইখানেই  সেই চরম শহরায়ণের সব লক্ষণ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ভাবীকালে ফলেও গেল তাদের কথা।  পূর্ব ইউরোপের হৃৎপিণ্ড স্বরূপ গোড়াপত্তন হলো চেক রিপাব্লিকের।  রাজধানী হলো প্রাহা, বিশ্ববাসী যাকে ডাকে প্রাগ।


চেক দেশের সুরম্য রাজধানী প্রাগ দর্শন করতে হয় বাসে চড়ে। প্রথমে নামতে হয় পাহাড়ের মাথায়  স্ট্রাহভ মনাষ্ট্রি দেখতে। মনাষ্ট্রিতে রয়েছে বিয়ার ব্রুয়ারি।  সেখান থেকে দুর্গ শহর প্রাগের  অতি সুন্দর একটা ভিউ পাওয়া যায়। এই ভিউপয়েন্টে গিয়ে চেকের বিশিষ্ট সন্ত সেন্ট নরবার্টিনের বৃত্তান্ত সচিত্র জানা  যায়।

স্ট্রাহভ মনাস্ট্রিতে সেন্ট নর্বার্টিনের রেলিক্স রাখা রয়েছে। আছে প্রকান্ড লাইব্রেরি, বিশাল ব‌ইয়ের সম্ভার, ব্যাসিলিকায়  ফ্রেসকো  ভার্জিন  মেরীর মোটিফ। ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সবকিছুই সযত্নে সংরক্ষিত। পাশেই রাখা রয়েছে প্রকাণ্ড এক অর্গ্যান, যা বাজিয়ে বিশ্বসেরা সুরসম্রাট মোৎজার্ট বলেছিলেন, এমন বড় ও সুন্দর অর্গ্যান তিনি আর কোনোদিনো বাজাননি। 

বাসের পাশাপাশি প্রাগ দেখতে হয় পায়ে হেঁটে। প্রাগের ওল্ড টাউন স্কোয়ারে ঘোরার মজাই আলাদা। প্রাগ কিন্তু শিল্প, সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত ছুঁয়ে আগন্তুক পর্যটকদের নিয়ে যায় ফিজিক্স ব‌ইয়ের পাতায়। কারণ, জোহান কেপলার ও টাইকো ব্রাহের জ্যোতির্বিদ্যার অনেক কিছু আবিষ্কার ঘটেছিল এই প্রাগ শহরে। পথের ধারে দুই বিজ্ঞানির স্ট্যচু প্রমাণস্বরূপ আজো দৃশ্যমান।

কথিত আছে, দুই দিকপাল জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে আর জোহানেস কেপলার ভাগ্যের টানে আসেন প্রাগে। টাইকো ব্রাহে ছিলেন উৎকৃষ্ট পর্যবেক্ষক আর কেপলার ছিলেন গণিতজ্ঞ। এই প্রাগেই টাইকো ব্রাহে কেপলারকে তার সহকর্মী করলেন। আকাশে হঠাৎ টাইকো দেখতে পেলেন অদ্ভুত সুপারনোভা। কেপলার তা থেকে অঙ্ক কষে সূত্র তৈরি করলেন। বিজ্ঞানের সাধনায় একে অপরের পরিপূরক ছিলেন তারা।


প্রাগের হটস্পট সেন্ট নিকোলাস চার্চ।  কোবলস্টোনের ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নির্বিঘ্নে পৌঁছা  যায়। কেননা, প্রাগের সবকিছু সংরক্ষণই অতি সুন্দর। অথচ এরা দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরেও নিজেদের অনেক ভেঙেচুরে আবারো অনেক সুন্দর করে গড়ে তুলেছে। সবকিছু রেখেছে  চমৎকার, পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি।

ট্রাম প্রাগের মনোরম বাহন। রাস্তা আর  ট্রামলাইনের চলেছে পাশাপাশি। কি অপূর্ব এই স্ট্রীটকারের মায়াবী নেটওয়ার্ক।  সারা শহরের অলিগলি রাজপথ থেকে ক্রিসক্রস ভাবে রঙীন সুন্দর সুন্দর ট্রাম চলে যাচ্ছে অনবরত। আর এরা কত সুন্দরভাবে এই যানটিকে ব্যাবহার করে সেটাই দেখবার বিষয়।  প্রাগের ট্রামের নেটওয়ার্ক চেক রিপাবলিকের মধ্যে সর্বোত্তম এবং সবচেয়ে বৃহৎ।

প্রাগের রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা যায় নিরাপদে ও অবলীলায়। জেব্রাক্রসিংয়ে পা দিয়ে ট্র্যাফিক লাইট মেনেই চলাচল করে সবাই। যান বা মানুষ, কারোই তাড়া নেই। নিয়ম ভাঙার কথা তো অকল্পনীয়। নিজস্ব ছন্দময় গতিতে সবাই চলছে নিজস্ব পথে। পশ্চিম ইউরোপের মতো রুদ্ধশ্বাস দৌঁড়ে চলার ছিটেফোঁটাও নেই পূর্ব ইউরোপের প্রাগে।

প্রাগে চোখে পড়বে অসাধারণ রেনেসাঁ স্থাপত্য। সমগ্র ইউরোপই নবজাগরণের মূলভূমি। চারিদিক স্থাপত্যকলা, ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। প্রাগের লেসার টাউন হলো নান্দনিকতার চূড়ান্ত প্রকাশস্থল। লেসার টাউন স্কোয়ারের  ল্যান্ডমার্ক হল রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কোয়ারের কেন্দ্রবিন্দুতে এই চার্চ।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এই নিকোলাস চার্চ। চার্চটির সংরক্ষণে সেনাবাহিনীর নিরলস পরিশ্রম আর নামীদামী স্থপতিদের পরিশ্রমে শিল্পকলায় ভরে উঠে চার্চের অন্দর ও বাইরের মহল।  সেন্ট নিকোলাস চার্চটি একাধারে গীর্জা অন্যধারে ক্লাসিকাল কনসার্টের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ। 


চার্চের বাইরে  থিকথিক করছে রেস্তোঁরা, পাব, দোকানপাট, ব্যুটিক আর প্রাগের বিখ্যাত মানুষ, ধনী লোকজনের ব্যারক স্টাইলের ঘরবাড়ি। ইন্টারন্যাশানাল এমব্যাসিগুলোও এখানে। এই  ব্যারক স্টাইল হল অত্যন্ত সুন্দর স্থাপত্যে নির্মিত বাড়ি। জানলার নীচে খোদাই করা মানুষের মুখ, বাড়ির ছাদের প্যারাপেটে পরী কিম্বা প্রবেশ পথে জীবজন্তুর অসামান্য আর্কিটেকচার।  পুরণো শহরের অনুপাতে অনেকটাই ছোট বলে এর নাম লেসার টাউন।  

চলতে চলতে প্রাগে পাওয়া যাবে অনেকগুলো ট্যানেল। মনে হবে একফালি অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে আবারো বড় রাস্তায় আসা হয়েছে। ডাকলেই পাওয়া যাবে  প্রাইভেট ট্রামের একটি কামরাকে। ম্যাজিকের মত ট্রাম এসে দাঁড়াবে সামনে। উঠে পড়তে হবে টুক করে। তারপর সুন্দর অনুভূতিতে স্বপ্নের মত সন্ধ্যেয় প্রাগের  ট্রামে চড়া আর একটা গলির মুখে অবতরণ করে পাথরের রাস্তা দিয়ে এক বিয়ার ব্রুয়ারীর মধ্যে প্রবেশ করা। বোহেমিয়ান বিয়ার বিশ্ববিখ্যাত। কোনও এক 'বিয়ার পাবে' সান্ধ্য আড্ডার অভিজ্ঞান শিহরণ জাগানিয়া। বিশাল সুদৃশ্য কাটগ্লাসের মাগে বিয়ার হাজির হবে। এককোণায় প্রৌঢ় বাজিয়ে চলেবেন একর্ডিয়ানে চেনাঅচেনা গানের সুর। আলো আঁধারিতে মায়াময় পরিবেশ তৈরি হবে। 

রহস্যে মোড়ানো ঘন্টাখানেক পর পাব থেকে বেরিয়ে এলে আলোকমালায় সজ্জিত রোমান্টিক প্রাগের রাজপথে উঁকি দেবে সামনে। দূরে দেখা যাবে বিখ্যাত ইউনিভাসিটি অফ প্রাগ, যেখানে এলবার্ট আইনস্টাইন থিওরিটিকাল ফিজিক্সে অধ্যাপনা করেছিলেন।  পাশেই রয়েছে চারজন মিউজিশিয়ানের অনবদ্য স্ট্যাচু, যা প্রাগের বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোর একটি। চারজনের হাতে চারটি বাদ্যযন্ত্র। স্থপতির কল্পনায় বিশ্বের বৃহত্তম চারটি নদী আমাজন, মিসিসিপি, গঙ্গা এবং দানিয়ুব-এর এক অনবদ্য কলতান এই চার বাদ্যশিল্পী চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছে । চার নৃত্যরত শিল্পীর চোখ বাঁধা। তাদের হাতে ম্যান্ডোলিন, ভায়োলিন, বাঁশী ও ট্রামপেট।  

ভ্লাতাভা নদীর ওপরে প্রাগের ঐতিহাসিক চার্লস ব্রিজ। ব্রিজে বিশাল চওড়া হাঁটার পথ। ব্রিজের ডাইনে বাঁয়ে সব পিলারের মাথায় দন্ডায়মান  সারেসারে  স্থাপত্য। রাজ পুরোহিত সেন্ট জন নেপোমুকের স্ট্যচুটি সর্বপ্রধান, যে স্ট্যাচুর মাথার চারিপাশ দিয়ে একটি ধাতব রিংয়ে পাঁচটি সোনালী স্টার খচিত।  ভ্লাতাভা নদীর ব্রিজের ঠিক ওই স্থানটি থেকে তাঁকে নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন রাজা। কারণ পুরোহিতের কাছে রাজা তাঁর  রাণীর স্বীকারোক্তির কথা জানতে চেয়েছিলেন  এবং পুরোহিত তা জানাতে চান নি।  অতি জাগ্রত এই স্ট্যাচুটি ছুঁলে নাকি মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। স্থানীয় মানুষ ব্রিজের গায়ে ছোট ছোট তালা লাগিয়ে দেয়, অনেকটা মাজারে গিয়ে লাল সূতো বাঁধার মত। নদীর ওপরে পুরণো ব্রিজ, নতুন ব্রিজ রাতের রূপসী প্রাগ শহরকে উন্মোচিত করে বহুবর্ণা আলোকমালায়।


যদি সেই রাতে আকাশে কৃষ্ণা চতুর্থীর চাঁদ থাকে, কিংবা ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে রূপসী প্রাগের পথ চলার শেষে পাওয়া যাবে প্রাগৈতিহাসিক ভৌতিক অনুভূতি। ছমছম করে ওঠবে গা। চোখের পলক পড়বে না একবারও। কানে ভাসবে প্রাগের পৌরাণিক উপাখ্যান।  মাথাকাটা এক সাধুর গল্প, যার অতৃপ্ত আত্মা এখনো ঘুরে বেড়ায় মনাষ্ট্রির সিঁড়িতে। সেই সাধু অভাবের তাড়নায় নিজের মাথা কেটে দেন।  হেডলেস মঙ্কের গল্প শুনে মনে হবে সামনে নিজের বাড়ি বা হোটেল নয়, অশরীরী আত্মায় ভরা তেপান্তরের দিগন্তব্যাপী মাঠ।

প্রাগের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রি, যার সামনে রয়েছে 'পাউডার গেট'। প্রাগের গথিক শৈলীতে নির্মিত টাওয়ার সহ প্রবেশদ্বার যেন মুঘল সম্রাটের 'বুলন্দ দরওয়াজ' অথবা 'গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া' বা 'ইন্ডিয়া গেট'। এই প্রবেশদ্বার প্রাগের ওল্ডটাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে।  সেখানেও রয়েছে নানা  গল্প। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সেন্ট এগনেস নামে এক রাজকন্যা আট বছর বয়সে বাগদত্তা হন আরেক দশ বছরের রাজপুত্রের। কিন্তু বিয়ের পর সংসারে বীতরাগ জন্মানো আর কৃচ্ছ্রসাধনে ব্রতী হয়ে ভক্তিমার্গে বিচরণের যান তারা।  ওল্ড টাউন অঙ্গনের ওয়েসনেসডে স্কোয়ার'-এ এ গল্প মশহুর, বোহেমিয়ার প্যাট্রন সেন্ট-এর নামে এই স্কোয়ারের নাম। 

এই ঐতিহাসিক স্থানটি হল প্রাগের হেরিটেজ সাইট।  মধ্যযুগে এখানে ঘোড়ার বাজার ছিল। তারওর বোহেমিয়ান রাজা চতুর্থ চার্লসের নিউ টাউন স্কোয়ার বানানোয় তা পুরনো শহরে পরিণত হয়। এখন আলোয় ঝলমলে প্রাগের নিউটাউন।  রাতের আলোয় ন্যাশানাল মিউজিয়াম, Wenceslas মনুমেন্ট  এক অদ্ভূত রোমান্টিক স্থান। আর ওল্ড টাউন গা ছমছম রূপকথা জগতের মতো ধূসর ও রহস্যঘেরা।

"নাইটস অফ দ্যা ক্রস স্কোয়ার" হলো প্রাগের বিখ্যাত রাজপথ,  টুরিস্টদের অন্যতম গন্তব্য। ডিজিটাল ক্লিকে, সেলফি স্টিকে রাজকীয় রাতপরী প্রাগের ছবি ক্যামেরায় ধরে সবাই এখানেই। এই পথ ও স্কোয়ার অন্যদিকে চার্লস ব্রিজকেও ছুঁয়েছে। স্কোয়ারের মধ্যখানে রাজা চতুর্থ চার্লসের বিশাল সেমি-গথিক স্ট্যাচু ।


শহরের আলোয় ঝলমলে অতিপ্রাচীন প্রাগ যেন যৌবনউদ্ভিন্না। চালর্স ইউনিভার্সিটির ৫০০ বছর পূর্তিতে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে স্মারক নির্মিত হয়েছে। স্কোয়ারের আশপাশের গথিক স্টাইল অট্টালিকার প্যারাপেটে দাঁড়িয়ে সারে সারে ভাস্কর্য। অপূর্ব নন্দন দৃশ্য প্রাগের সর্বত্র উদ্ভাসিত করে রেখেছে। 

পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের শহর প্রাগের নিজস্বতা অক্ষুণ্ণ হলেও সেখানে পশ্চিম ও দূরপূর্ব ইউরোপের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। প্রাগ যেন নানা সভ্যতা ও সংস্কৃতির মিলন ও সঙ্গমস্থল। বিশেষত পাশের বলকানের প্রভাব প্রাগে অলঙ্ঘনীয় রূপে পরিব্যাপ্ত। বলকান অঞ্চল বলতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চলকে বোঝায়। এর পূর্বে কৃষ্ণ সাগর, পশ্চিমে অ্যাড্রিয়াটিক সাগর, দক্ষিণে ভূমধ্যসাগর। দানিউব, সাভা ও কুপা নদীগুলো অঞ্চলটির উত্তর সীমানা নির্ধারণ করেছে। বুলগেরিয়া থেকে পূর্ব সার্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বলকান পর্বতমালার নামে অঞ্চলটির নাম এসেছে।

বলকান অঞ্চলের সন্নিহিত চেক প্রজাতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে বোহেমিয়া নামেও পরিচিত মধ্য ইউরোপের একটি ভূবেষ্টিত রাষ্ট্র। দেশটির দক্ষিণে অস্ট্রিয়া, পশ্চিমে জার্মানি, উত্তর-পূর্বে পোল্যান্ড এবং দক্ষিণ-পূর্বে স্লোভাকিয়া অবস্থিত। চেক প্রজাতন্ত্র দেশটিতে রয়েছে পাহাড়ি ভূমি যা প্রায় ৭৮,৮৭১ বর্গকিলোমিটার (৩০,৪৫২ বর্গমাইল) অঞ্চলে বিস্তৃত এবং এর অধিকাংশেই নাতিশীতোষ্ণ মহাদেশীয় ও মহাসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। দেশের মধ্যভাগে অবস্থিত বৃহত্তম শহর ও রাজধানী প্রাগ। অন্যান্য শহরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বার্নো ও অস্ত্রাভা।

নবম শতাব্দীর শেষের দিকে মোরাভিয়ার অধীনে বোহেমিয়ার ডাচি প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্বে ১০০২ সালে রোমান সাম্রাজ্যের একটি ইম্পেরিয়াল রাজ্য হিসাবে এটি স্বীকৃত হয়েছিলো এবং ১১৯৮ সালে এটি একটি রাজ্যে পরিণত হয়। ১৫২৬ সালে মোহাচের যুদ্ধের পর, বোহেমিয়ার পুরো সাম্রাজ্যটি ধীরে ধীরে হাবসবার্গ রাজতন্ত্রের সাথে একীভূত হয়। এসময় প্রোটেস্ট্যান্ট বোহেমিয়ান বিদ্রোহ ত্রিশ বছরব্যাপী হোয়াইট মাউন্টেনের যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। যুদ্ধের পর হাবসবার্গরা তাদের শাসনকে সুসংহত করে। ১৮০৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সাথে সাথে এসব ভূমি অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ হয়ে ওঠে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে, চেক ভূমি আরও শিল্পোন্নত হয়ে ওঠে এবং ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পতনের পরে এর বেশিরভাগ অংশ প্রথম চেকোস্লোভাক প্রজাতন্ত্রের অংশ হয়ে ওঠে। চেকোস্লোভাকিয়া মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের একমাত্র দেশ ছিল, যা আন্তঃযুদ্ধকালীন সময়কালে সংসদীয় গণতন্ত্র বজায় রেখেছিল। ১৯৩৮ সালের মিউনিখ চুক্তির পর নাৎসি জার্মানি পদ্ধতিগতভাবে চেক ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ১৯৪৫ সালে চেকোস্লোভাকিয়া পুনরুদ্ধার করা হয় এবং ১৯৪৮ সালে একটি অভ্যুত্থানের পরে এটি পূর্ব ব্লকের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সরকার ও অর্থনীতির উদারীকরণের প্রচেষ্টা ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের সময় সোভিয়েত-নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের মাধ্যমে দমন করা হয়। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরের 'মখমল বিপ্লব' দেশে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায়। ১ জানুয়ারি ১৯৯৩ তারিখে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে যায় এবং এর সাংবিধানিক রাজ্যগুলো চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়ার স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

প্রাগ বা প্রাহা চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৩তম বৃহত্তম শহর। এছাড়াও বোহেমিয়ার ঐতিহাসিক রাজধানী। ভুলটাভা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহরে ১.৩ মিলিয়ন মানুষের বাস, যখন তার নগর জোনগুলোতে প্রায় ২.৭ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাস বলে অনুমান করা হয়। শহরে নাতিশীতোষ্ণ মহাসাগরীয় জলবায়ু বিদ্যমান। এখানে গ্রীষ্মকাল অপেক্ষাকৃত উষ্ণ এবং শীতকাল অপেক্ষাকৃত শীতল।

প্রাগ পূর্ব ও মধ্য ইউরোপের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র, এক সমৃদ্ধ ইতিহাস যাকে পূর্ণতা দিয়েছে। রোমানেস্ক স্থাপত্য যুগে প্রাগ শহর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গথিক, রেনেসাঁ, বলকান ও বারোক স্থাপত্য যুগে এর বিকাশ ঘটে। প্রাগ বোহেমিয়া রাজ্যের রাজধানী এবং কয়েকজন পবিত্র রোমান সম্রাটের বাসস্থান ছিল। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রাজা চতুর্থ চার্লস (শা. ১৩৪৬-১৩৭৮ খ্রি)। এটি হ্যাব্সবার্গ রাজ্যের এবং অস্ট্রো-হাংগেরীয় সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। দুই বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর কমিউনিস্ট আমলের মধ্যবর্তীকালে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী হিসাবে বোহেমীয় ও প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার, ত্রিশবর্ষীয় যুদ্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে এটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।

প্রাগ কিছুসংখ্যক বিখ্যাত সাংস্কৃতিক আকর্ষণের কেন্দ্র, যাদের অনেকগুলো বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের সহিংসতা ও ধ্বংসের পরেও টিকে রয়েছিল। এর প্রধান আকর্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে 'প্রাগ ক্যাসল' (প্রাগ দুর্গ), চার্লস ব্রিজ, (প্রাগ জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়িযুক্ত) ওল্ড টাউন স্কয়ার, ইহুদি কোয়ার্টার, পেট্রিন পাহাড় ও দুর্গ।

১৯৯২ সাল থেকে প্রাগের বিস্তীর্ণ ঐতিহাসিক কেন্দ্র ইউনেস্কোর 'ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। শহরটিতে দশটির অধিক বড় বড় জাদুঘর, অসংখ্য নাট্যশালা, গ্যালারি, সিনেমা এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। একটি সম্প্রসারিত আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা শহরটিকে সংযুক্ত করেছে। এখানে বহু সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় আছে। প্রাগের 'চার্লস ইউনিভার্সিটি' মধ্য ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। গ্লোবাল এন্ড ওয়ার্ল্ড সিটিজ রিসার্চ নেটওয়ার্ক-এর গবেষণা অনুযায়ী প্রাগ 'আলফা-গ্লোবাল সিটি' হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ। ২০১৯ সালে মারসার কর্তৃক শহরটি পৃথিবীর ৬৯তম সর্বাধিক বাসযোগ্য শহরের মর্যাদা লাভ করে। একই বছর পিকসা ইন্ডেক্স প্রাগকে পৃথিবীর সবচেয়ে বাসযোগ্য ১৩তম শহরের স্থান দেয়। শহরটির সমৃদ্ধ ইতিহাস তাকে জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী শহরটিতে প্রতি বছর ৮.৫ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক দর্শনার্থী ভ্রমণে আসে। ২০১৭ সালে প্রাগ লন্ডন, প্যারিস, রোম, ইস্তানবুলের পর সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী গ্রহণকারী ৫ম ইউরোপীয় শহর হিসাবে তালিকাবদ্ধ হয়।

প্রাগ ভ্রমণের উৎকৃষ্ট সময় মে থেকে আগস্ট মাস। চেক রিপাবলিকের ক্যাপিটাল প্রাগে যেতে যেকোনো ইউরোপিয়ান শহর থেকেই ফ্লাইট নেওয়া যায়। অথবা টুরগ্রুপের সাথে গেলে তারা বাস বা ট্রেন প্রোভাইড করে। হট টুরিস্টপ্লেস প্রাগে সবধরণের হোটেলের রমরমা। প্রত্যেক হোটেলেই বেড এন্ড ব্রেকফাস্ট ইন্ক্লুডেড।

প্রাগ এমন এক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, রোমান্টিক শহর, যাতে রয়েছে স্বর্গীয় ছোঁয়া, প্রাকৃতিক পরশ ও ঐতিহ্যের দ্যোতনা। প্রাগ শহরকে সংক্ষিপ্ত ভ্রমণের শেষে বিদায় জানিয়েও রেহাই পাওয়া যায় না। জীবনের বাঁকে বাঁকে স্বপ্নে এসে ধরা দেয় প্রাগসুন্দরী। মনে হয়, যে শহরে হাঁটতে আরও আরও পথ বাকী। অনায়াসে, অবলীলায়, জীবনভর যে শহরকে নিজের একান্ত শহরের মতো বুকে লুকিয়ে রাখা যায় এবং কখনোই বিদায় জানানো যায় না।

ইউরোপের আধুনিক কবি  Mitchell Duran যা বিবৃত করেছেন কাব্যিক ব্যাঞ্জনায়:

"Goodbye Prague, to a city

I never thought I'd know.

Goodbye Prague, to a heaven

that is lined with shattered beer bottles and stamped out cigarettes

the junkies and the hobo's here still manage to get a  few puffs out of."

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;