অন্যের মনোযোগ আকর্ষণে করণীয়
মানুষকে আপন করে নেওয়ার কলা কৌশল পৃথিবীর খুব কম মানুষই জানে। এটি একটি বিশেষ দক্ষতা। হয়তো দেখে থাকবেন আপনারই পরিচিত কেউ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অন্য যে কোনো মানুষের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পারে। মানুষের সাথে খুব সুন্দরভাবে মিশতে পারে। কিছু কিছু মানুষের ভেতর স্বভাবগতভাবেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকে। তাদের কথা এবং কাজের দ্বারা তারা যে কাউকে এক নিমিষেই প্রভাবিত করতে পারেন। কিন্তু অনেকেই আবার এই মনোযোগ আকর্ষণ করতে না পেরে হতাশায় ভোগেন। আজকের এই ফিচারটি মূলত তাদের জন্যেই।
সম্প্রতি একটি গবেষণায় এমন কিছু তথ্য উঠে এসেছে যেখানে কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো একজন মানুষকে তার দিকে আরেকজনের মনযোগ টেনে আনতে সহায়তা করে। ইউসি বার্কলের গবেষক জুলিয়ানা শ্রোয়েডার, তার সহযোগী শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নিকোলাস এপল্লি এবং মাইকেল কার্ডাস বেশ কয়েকজন মানুষের ওপর গবেষণা করে তারা একটি ফল বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন। শ্রোয়েডার বলেন বেশ কিছুদিন আগে তিনি অজ্ঞাতনামা একজন রাজনীতিবিদের বক্তব্য পড়েছিলেন খবরের কাগজে। যখন তিনি বিবৃতিটি পড়েন, তখন সেই রাজনীতিবিদকে তার প্রচণ্ড বোকা মনে হয়েছিল। কিন্তু একই খবর তিনি পরদিন শুনলেন রেডিওতে। অবাক করা ব্যাপার হলো তখন রাজনীতিবিকের কথাগুলো তার কাছে আসলেই যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল। এবং আগের দিনে বক্তব্যটি পড়ে তিনি সে ব্যাপারে যতটা ভেবেছিলেন, রেডিওর বক্তব্য তার মনোযোগ ঠিক একইভাবে সেদিকে টেনে নিতে পারল না। এরপরই তিনি মূলত সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবার। আর সে লক্ষ্যেই তিনি মানুষের এই মনোযোগ আকর্ষণের পেছনের রহস্য নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু করেন।
গবেষণা শুরুর প্রাক্কালে জুলিয়ানা শ্রোয়েডার, নিকোলাস এপল্লি এবং মাইকেল কার্ডাস প্রাথমিকভাবে কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। যেখানে তারা দেখতে পান সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্কিত কিছু পোস্ট করলেই একটি অনলাইন বিতর্ক শুরু হওয়া নিশ্চিত। সোশ্যাল মিডিয়াতে মানুষ যতটা আগ্রহ নিয়ে তর্ক করে, বাস্তব জীবনে ঠিক একইভাবে সেটা করে না। কেননা এখানে তর্ক করা সহজ। চাইলেই আপনি আপনার পক্ষে বা বিপক্ষের যুক্তি দিতে পারবেন, পারবেন বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত তুলে ধরতে। এছাড়াও যে যার নিজস্ব নিরাপদ জায়গায় বসে বসে কথা বলেন বিধায় স্বাচ্ছন্দও কাজ করে ভেতরে। আর তাই এভাবেই অনেকেই প্রায়ই বিতর্কিত কার্যক্রমের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকেন।
কিন্তু এতে করে বিস্তারিত জানা যায় না। তাই তারা এই বিষয়টিকে ভালোভাবে বুঝবার সিদ্ধান্ত নেন। যে গবেষণাটি পরে সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সে প্রকাশিত হয়। এই গবেষণার জন্য গবেষকরা ছয়জনকে একটি ক্যামেরার সামনে বসিয়েছিলেন এবং তিনটি আলাদা বিষয়ে তাদের নিজেদের মতামত দেওয়ার অনুরোধ জানান। যেটা রেকর্ড করে রাখা হয়। ছয়জনকে দুই জনের তিনটি দলে ভাগ করা হয়। দুজন গর্ভপাতবিরোধী অবস্থানের পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়েছিলেন, দুজন আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন এবং দুজন র্যা প বনাম দেশীয় সংগীতের মতো হালকা দুটি বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেছিলেন।
এখানেই শেষ নয়। এরপরে তাদেরকে আলাদা আলাদা করে তাদের কথোপকথনের রেকর্ড এবং স্ক্রিপ্ট দেওয়া হয়। যেখানে নাম না জেনে অজ্ঞাতভাবে একজন অন্য জনের কথা শুনেছিলেন এবং পড়েছিলেন। এরপরে তারা নিজদের মতো করে প্রতিটা বক্তব্যকে রেটিংস দিয়েছিলেন। যেখানে কিছু বিষয়কে মানদণ্ড হিসেবে ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল যেমন অংশগ্রহণকারীদের তাদের বুদ্ধি এবং সংবেদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে তাদের বক্তব্য কতটা পরিশুদ্ধ, যৌক্তিক, সুপরিচিত এবং যান্ত্রিক ছিল তা বলতে জন্য বলা হয়েছিল। যেখানে দেখা যায় অনেকেই তাদের নিজেদের বিরুদ্ধমতের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে যান এবং বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া করেন। আবার কেউ কেউ কারো কারো বিশেষ কথায় খুব প্রভাবিতও হন।
গবেষকরা বলেন, “যখন দুজন ব্যক্তি আলাদা বিশ্বাস রাখে তখন কেবল ভিন্ন ভিন্ন মতকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই নয় তবে তার বিরোধী ব্যক্তির মনকে তুচ্ছ করারও একটি প্রবণতা তার মধ্যে থাকে।” গবেষকরা আরো বলেন আপনি অবশ্যই আপনার প্রতিপক্ষের মন পড়তে পারবেন না, সুতরাং আপনি অন্যান্য সূত্রগুলো বেছে নেন। কিন্তু যখন আপনাকে সমস্ত কিছু পাঠ করতে হয়, তখন খুব কম ক্লু পাওয়া যায়। কেননা লেখাগুলো মুছে ফেলা যায়। কিন্তু কথা যা একবার বলা হয় তার আর ফেরত নেওয়া যায় না। তাই হাতের লেখার চেয়ে মুখের কথাতেই মানুষের বেশি কাছাকাছি যাওয়া যায় বলে মনে করেন সকলে।
গবেষণাপত্রে এসব কিছু উল্লেখ করে তাদের আচরণসমেত একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। সেখানে তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করে এমন কিছু গুণাবলি পাওয়া যায় যেগুলোর মাধ্যমে একজন লোক সহজেই তার প্রতি আরেকজন লোককে আকৃষ্ট করতে পারেন।
গবেষণা বলে, যেসব লোক তাদের কথার শুরুতে কুশল বিনিময় করেন, নম্র এবং শান্ত ভাষায় কথা বলেন তাদেরকে লোকেরা পছন্দ করেন বেশি। তারা সহজে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এছাড়াও কথা বলার সময় আপনার আওয়াজও একটা বড় ভূমিকা রাখে। এত উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না যেটা শুনতে কর্কশ শোনায়। আবার এত নিচু স্বরেও কথা বলা যাবে না যেটা অন্যের কানে ঠিকমতো পৌঁছায় না। তাই এক্ষেত্রে অবলম্বন করতে হবে মধ্যম পন্থা।
কথা বলার সময় নিজের কথার সাথে মিলিয়ে মুখের অঙ্গভঙ্গি এবং এবং গলার স্বরেও নিয়ে আসতে হবে পরিবর্তন। এমন যেন না হয় আপনি হাসির কোনো খবর বিমর্ষ মুখে দিচ্ছেন কিংবা বিমর্ষ কোনো খবর হাসিমুখে দিচ্ছেন। এতে করে আপনার ব্যাপারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং লোকে আপনাকে এড়িয়ে চলবে।
দুজন ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে যে বিষোয়গুলো সমজাতীয়, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করলে সহজে মন জয় করে ফেলা যায়। দুজন লোকের রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় কিংবা সামাজিক মূল্যবোধ যদি এক হয়, দেখা গেছে তাদের মধ্যে খুব সহজে হৃদ্যতা তৈরি হয়। তাই কথাবলার সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন কারো কোনো মূল্যবোধ্যে আঘাত না আসে। গবেষণায়ও দেখা যায় যখন একজন আরেকজনের সাথে মিলের বিষয়গুলো বলছিলেন তখন তাদের চেহারায় একটা আভা চলে আসে। যেটা তাদেরকে বক্তার প্রতি আগ্রহী করে তুলে।
গবেষকরা সর্বোপরি যে বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন সেটা হলো নিজেকে একদম খুলে না দেওয়া। অর্থাৎ নিজের ভেতর কী কী আছে সব বলা থেকে বিরত থাকা। কিছুটা ধোঁয়াশা রাখা। কেননা মানুষ কিউরিয়াস প্রাণী। তাই তাদের কিউরিওসিটি ধরে রাখতে হয়। যদি কোনো ধোঁয়াশা না থাকে তবে লোকে আপনার ব্যাপারে খুব দ্রুত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই কিছুটা রয়ে সয়ে কথা বলতে হবে।