জিনস ক্রেজ
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে অভিনেতা ছিলেন হলিউডের। সেসময় তার প্রায় সবগুলো মুভিতে দেখা যায় তিনি জিনস পরিহিত। তিনি বলেছিলেন, ‘জিনস এত নির্ভরতার কাপড় যে নোংরা হয়ে যাওয়ার ভয় নেই, রং মরে যাওয়ার ভয় নেই, যত বেশি রং ফেড হবে ততোই জিনসের কদর বাড়ে। জিনসকে পপুলার করেছে ‘বিটলস’ ব্যান্ড গ্রুপও। হিপ্পিরা তো জিনস ছাড়া কিছুই বুঝত না। সেসব তো বহু বহু আগের কথা। সর্বশেষ বলিউডের অভিনেত্রী ক্যাটরিনা কাইফ একটি টিভি শোতে বলেছেন, “জিনস ছাড়া ভাবতে পারি না। বয়ফ্রেন্ড না থাকলেও চলবে। কিন্তু জিনস মাস্ট।” এই জিনস কিভাবে পপুলার হলো এবং কিভাবে একজন শুরুর জিনস কারিগর প্রতারিত হলেন সেসব নিয়েও অনেক গল্প আছে।
জেমস মার্শাল যদি ক্যালিফোর্নিয়ার কলমা এলাকায় স্বর্ণের খনি না খুঁজে পেতেন ১৮৪৮ সালের ২৪ জানুয়ারি, তাহলে হয়তো জিনসের প্রচলন আরো দেরিতে শুরু হতো। কারণ ওই ঘটনার আগে কেউ জিনস পরেননি। জেমস মার্শাল স্বর্ণের খনি খুঁজে পেয়েছেন এটি প্রচার পেলে বিভিন্ন দেশ থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় হাজির হয়েছিলেন প্রায় ৩ লাখ ভাগ্যান্বেষী। শ্রমিক হয়ে নেমে পড়েছিলেন স্বর্ণের খনিতে সোনা খুঁজতে। সেসময়ও জিনস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একটা সময় জিনস পরতেন শ্রমিকরা। এখন পরেন অভিজাতরাও। জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে জিন্স। কাজের সুবিধার জন্যও জিন্সের বেশ কদর। নারীদের কাছে জিন্সের প্যান্ট সমাদৃত। আসুন জেনে নেওয়া যাক জিন্সের ইতিহাস।
সেসময় সানফ্রান্সিসকোতে দোকান খুললেন বর্ন লিওয়ব স্ট্রস নামে এক জার্মান। তিনি মূলত পোশাক ব্যবসায়ী। জার্মানিতে তাদের পারিবারিক ডাই এবং কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সেই ব্যবসারই শাখা সানফ্রান্সিসকোতে খুলেছিলেন লিওয়ব স্ট্রস। আমেরিকা আসার আগে লিওয়ব তার নামটা লিভাই করে নিয়েছিলেন। তার দোকানের নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন জার্মান দর্জি জ্যাকব ডেভিস। হতদরিদ্র ডেভিসও জার্মানি থেকে আমেরিকায় পা রাখেন ভাগ্যের অন্বেষণে। জ্যাকবের তৈরি প্যান্ট শ্রমিকদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তাও পায়। পাশাপাশি প্যান্টের রঙ গাঢ় নীল হওয়ায় সহজে তা ময়লা হতো না। ১৮৯০ সালের মধ্যে তার সংস্থার তৈরি ‘জিনস’ আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯২০ সালের মধ্যে আমেরিকা ছেয়ে ফেলল লিভাইস-এর তৈরি করা ‘ডেনিম ওয়েস্ট’ জিন্স।
অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল এই কাজ। শ্রমিকেরা সাধারণ পোশাক পরে খনিতে নামতেন কিন্তু রোজ তাঁদের জামা প্যান্ট ছিঁড়ে যেত। সেগুলি তাঁরা নিয়ে যেতেন লাটভিয়া থেকে আমেরিকায় আসা দর্জি জ্যাকব ডেভিসের কাছে। তিনি হিমশিম খেয়ে যেতেন জামা প্যান্টে তালি মারতে মারতে। তাঁর মাথায় ঘুরছিল একটি ভাবনা। কী করে খনি শ্রমিকদের হাতে শক্তপোক্ত কাপড়ের প্যান্ট তুলে দেওয়া যায়, যেগুলি সহজে ছিঁড়বে না এবং যা পরে শ্রমিকরা কষ্টসাধ্য কাজগুলো করতে পারবেন। ফ্রান্সের Nîmes শহরে এই সুতো তৈরি হতো বলে de Nîmes থেকে denim শব্দটা এসেছে। ফ্রান্সের তাঁতীদের তৈরি করা এই ডেনিমের সুতো দিয়ে ইতালির জেনোয়া শহরের এক তাঁতী একধরনের শক্তপোক্ত কাপড় বানিয়েছিলেন। তার নাম ছিল জিন ফুস্তিয়ান। যেহেতু জেনোয়া শহরে তৈরি তাই এই নাম। পরে জিন ফুস্তিয়ানের নামটি থেকে ফুস্তিয়ান শব্দটি ছেঁটে ফেলে নাম দেওয়া হয় জিনস।
জার্মান দর্জি ডেভিস খুঁজে খুঁজে এই জিনসের কাপড়ই বার করেছিলেন গোডাউন থেকে। অবাক হয়েছিলেন লিভাই স্ট্রস। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছিলেন ডেভিস। সেই মোটা কাপড় দিয়েই বানিয়ে ফেলেছিলে শ্রমিকদের প্যান্ট। শক্ত কাপড়, মোটা সুতোর সেলাই আর পকেটের কোণে কোণে রিভেট মারা প্যান্ট খনি শ্রমিকদের খুব পছন্দ হয়েছিল। প্যান্টগুলি ছিল অত্যন্ত টেকসই এবং প্যান্টের রং গাঢ় নীল হওয়ায় তা ময়লা হলেও ময়লা দেখত না। বাকিটা ইতিহাস।
প্রথম দিকে জিনসের কাপড়ে তৈরি প্যান্ট পরতেন শ্রমিক ও কাউবয়রা। গরিব শ্রেণীর কিশোরদের মধ্যেও এর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছিল। ডেভিসের তৈরি করা প্যান্টের সব পরিস্থিতি সহ্য করার ক্ষমতা দেখে আকর্ষিত হচ্ছিলেন সমাজের উঁচু শ্রেণীও। জিনসের বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে ডেভিস আর লিভাই স্ট্রস মিলিতভাবে একটি সংস্থা খুললেন যার নাম দিলেন ‘লিভাই স্ট্রস অ্যান্ড কোং’। ১৮৭৩ সালের ২০ মে এই বিশেষ ধরনের প্যান্ট তৈরির পেটেন্ট পেল লিভাই স্ট্রস অ্যান্ড কোং।
কিন্তু দুজনের সম্পর্কে ফাটল ধরল দ্রুত। ব্যবসা বলে কথা। ১৮৮০ সালে নিজের আলাদা প্রতিষ্ঠান খুললেন লিভাই স্ট্রস। ১৮৯০ সালের মধ্যে তাঁর সংস্থার তৈরি করা জিনস সারা আমেরিকায় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু অর্থ না-থাকায় ডেভিস জিনসের পেটেন্ট পাননি। পেটেন্ট ছিল লিভাই স্ট্রসের নামে। তাই লিভাই স্ট্রসের বিশ্বাসঘাতকথায় কারণে একদিন জিনসের জগৎ থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন জ্যাকব ডেভিস। জিনসের প্যান্টের স্রষ্টা।