তারেক মাসুদ : বাংলা চলচ্চিত্রের মহাজীবন
যাত্রা শুরু হবার পর থেকেই চলচ্চিত্র বর্তমান সমাজ, অতীতের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতের প্রত্যাশাকে বিম্বিত করে আসছে। ‘২০০১: এ স্পেস অডিসি’-এর মতো সায়েন্স ফিকশন এবং ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’-এর মতো ইতিহাসকে পটভূমি ধরে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে হলিউডে। বাংলার সমাজ-বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক টানাপোড়েনে অভিজ্ঞতা আরেকটু ভিন্ন। কুসংস্কার, পশ্চাৎপদতা, ধর্মীয় উগ্রতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং তার ভেতর থেকেই গড়ে ওঠা কতিপয় স্বপ্নালু মানুষ নিয়েই এখানকার জীবন। বাংলার সেইসব জমিয়ে রাখা কথাগুলো খুব যত্ন করে সাজিয়ে তুলে ধরেছেন এক চলচ্চিত্রকার—তারেক মাসুদ। সত্যজিৎ রায় ও জহির রায়হানের পর বাংলা চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদ তাই প্রধান সেনাপতি। প্রায় মুখ থুবড়ে পড়া এক শিল্পকে পুনরায় মাথা তুলে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে গেছেন আজীবন।
তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুর গ্রামে। মাদরাসায় পড়াশোনার মধ্য দিয়ে শিক্ষাজীবনের শুরু হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শুরু হয় সাধারণ শিক্ষা। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে কিছুদিন ঘুরাঘুরি করে থিতু হন নটরডেম কলেজের মানবিক বিভাগে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স সমাপ্ত করেন। অনেক আগে থেকেই তারেক মাসুদ চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। স্বাধীনধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রগণ্য পরিচালক তিনি; যা শুরু হয়েছিল আশির দশকের মধ্যভাগে। বাংলা চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত নির্মাতা আলমগীর কবিরের দ্বারা ছিলেন গভীরভাবে প্রভাবিত।
তারেক মাসুদের প্রথম কাজ আদম সুরত (The Inner Strength) নির্মিত হয় ১৯৮৯ সালে। এটি মূলত চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতানের জীবনভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র; যার কাজ শুরু ১৯৮২ সালে। নির্মাণের উৎস হিসাবে তারেক মাসুদ প্রায় সাত বছর শিল্পীর সান্নিধ্যে কাটান। বস্তুত এই সময়েই তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চায় তার সংযুক্তি ছিল। চিত্রা নদীর পাড়ে ধারণ করা হয় আদম সুরত। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তারেক মাসুদ বলেছেন, “চিত্রা নদীর পাড়ে থাকেন চিত্রশিল্পী সুলতান। আমরা যখন সুলতান ভাইয়ের ওপর ছবি বানাতে আসলাম; তখন চিত্রাই হয়ে উঠল সমস্ত কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।”
নারী সমাজের অধিকার ও ভূমিকা এবং তার বিপরীতে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সূক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তুলতে তারেক মাসুদ আশ্রয় নিলেন নতুন কাজের। ১৯৮৫ সালে নির্মিত হলো প্রামাণ্যচিত্র ‘সোনার বেড়ী’। আদম সুরত এবং সোনার বেড়ী—দুটো প্রামাণ্যচিত্রই সমকালে এবং পরবর্তী সময়ে তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। যদিও জনসাধারণে কাছে তখনও খুব একটা জনপ্রিয়তা পাননি।
চলচ্চিত্রকার হিসাবে তারেক মাসুদ আলোচিত হয়ে উঠেন ‘মুক্তির গান’-এর মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজনির্ভর এই প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয় ১৯৯৫ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বল্পকালীন প্রবাসজীবনে আবিষ্কার করেন মার্কিন পরিচালক লিয়ার লেভিনের ধারণকৃত ফুটেজ। ঘটনাটা তাকে ব্যাপকভাবে ধাক্কা দেয়। লিয়ার লেভিনের সেই ফুটেজ এবং পাশাপাশি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ১৯৭১ সালের ফুটেজগুলো একত্রিত করতে উঠেপড়ে লেগে যান। তাঁকে সঙ্গ দেন আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। অনেক প্রচেষ্টার পর আলোর মুখ দেখে ‘মুক্তির গান’। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইডের পর তারেক মাসুদের এই মুক্তির গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম প্রামাণ্য দলিল হিসাবে বিবেচিত। মুক্তির গান ‘ফিল্ম সাউথ এশিয়া-১৯৯৭’ থেকে বিশেষ সম্মাননা অর্জন করে। সারা দেশে বিকল্প পরিবেশনায় প্রদর্শিত হয় মুক্তির গান। নানা শ্রেণির মানুষ নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেন। তারেক মাসুদ এবার নেন দ্বিতীয় পদক্ষেপ। সেই সব প্রতিক্রিয়া নিয়ে ১৯৯৯ সালে নির্মিত হয় ভিডিও চলচ্চিত্র ‘মুক্তির কথা’। প্রচলিত ও প্রাধান্য পাওয়া মধ্যবিত্তের বয়ানের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন একটা ভাষ্য উঠে এসেছে এই নির্মাণের ভেতর দিয়ে।
তারেক মাসুদের অভিযাত্রায় তখনও অনেক সৃষ্টি বাকি। দেশের মাটিতে চলচ্চিত্রকার হিসাবে তাঁর খ্যাতি তুঙ্গেই। বিদেশের মাটিতে সেই খ্যাতি এনে দিল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘মাটির ময়না’। ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ফিপ্রেস্কি আন্তর্জাতিক সমালোচক পুরস্কারের আওতায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার অর্জন করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পরিচালকের আত্মজীবনীনির্ভর চলচ্চিত্র এটি; যেখানে মাদ্রাসা পড়ুয়া এক বালকের চোখে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা প্রতিভাত হয়েছে। উঠে এসেছে বাংলার লোকজ সংস্কৃতি ও সমাজ দর্শন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় পরবর্তী ইউরোপে মাটির ময়না আরো বেশি করে আলোচিত হতে থাকে।
অনন্য চলচ্চিত্রের তালিকায় আস্তে আস্তে যুক্ত হয় ‘অন্তর্যাত্রা’, ‘নরসুন্দর’ এবং ‘রানওয়ে’-র নাম। অন্তর্যাত্রা মুক্তি পায় ২০০৬ সালে। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অভিবাসী বাংলাদেশিদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে বারবার শেকড়ের টানে ফিরে আসার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ২০০৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের কাহিনী আরো ভেতরের। সাধারণ মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে বিহারীদেরকে পাকসেনার সাহায্যকারী ও দোসর হিসাবে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। তারেক মাসুদের মূলভাষ্য একে কেন্দ্র করেই। সিনেমাতে দেখা যায় পাকিস্তানি বাহিনীর তাড়া খেয়ে পলায়নরত এক মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচিয়ে দেয় বিহারী নরসুন্দররা। বিহারীরা এখানে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষ না; সহযোগী পক্ষ হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে। তারেক মাসুদ বস্তুত এর মাধ্যমে ঢালাওভাবে কারো ওপর অভিযোগ করাকে খণ্ডন করেছেন। সবিশেষ রানওয়ে সমসাময়িক বাংলাদেশের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলেছে। বিশেষ করে ২০০৪-৫ সালের জঙ্গিবাদের সমস্যা। মৃত্যুর আগে নির্মীয়মাণ চলচ্চিত্র ‘কাগজের ফুল’-এর মূল বিষয়বস্তু ছিল ১৯৪৭ সালের দেশেবিভাগ। বস্তুত গোড়ায় ইসলামী ভাবধারার অতীত অভিজ্ঞতা থাকার কারণে অন্য সবার থেকে তাঁর দৃষ্টি ছিল অনেক বেশি সূক্ষ্ম।
বাঙালির জাতীয় পরিচয়, লোকজ বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তারেক মাসুদের চোখে ধরা দিয়েছে অন্যরকম বাস্তবতা নিয়ে। সারাটা জীবন তাই তাঁর রচনায় সেই ঘ্রাণ। আজন্ম দেশের মাটি আর মানুষ এবং তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাকে সিনেমার পর্দায় বিম্বিত করে জনতার সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। সে ক্ষেত্রে তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। আহমদ ছফার মাধ্যমেই ক্যাথরিনের সাথে তারেকের পরিচয়। দুজনের সন্তান নিষাদ মাসুদ। ব্যক্তিগত জীবনেও অসাধারণ মানুষটি লিখেছেন গানও; যেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে ক্যাথরিন প্রকাশ করেছে এলবাম। স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন মিলিয়ে তারেক মাসুদের মোট চলচ্চিত্র ১৬টি।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। মানিকগঞ্জ ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার লোকেশেন ঠিক করা হলো। সকল পরিকল্পনা শেষ করে ঢাকার পথে রওনা হলেন তারেক মাসুদ। সাথে স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীর। কিন্তু বাসায় পৌঁছানোর আগেই তাঁর যাত্রা ঘুরে গেল পরপারের দিকে। বাংলাদেশের চিরন্তন সমস্যা সড়ক দুর্ঘটনায় বলি হলো আধুনিক বাংলা চলচ্চিত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ক্যাথরিন মাসুদ তারেকের স্বপ্ন বাস্তবতায় আনতে শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘তারেক মাসুদ মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে টিএসসি ও শামসুন্নাহার হলের মাঝখানে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিস্মারক।