সৌদি আরব কি মুসলিম দেশগুলোর বন্ধু?
ইস্তানবুল দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার দণ্ড নিয়ে সমালোচনার মুখে সৌদি আরব। অথচ যুক্তরাষ্ট্র তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। গতবছর মিসিসিপিতে এক শোভাযাত্রায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, সৌদি আরবকে রক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি সৌদি বাদশাহর উদ্দেশে বলেছেন, “বাদশাহ, আমরা আপনাকে রক্ষা করছি। আমাদের সমর্থন ছাড়া আপনি দুই সপ্তাহও টিকবেন না।” সৌদি আরব বিশ্বের শীর্ষ তেল রপ্তানিকারক দেশ। তাদের তেলের বড় ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র। আবার সৌদি আরবের অস্ত্রের বড় জোগানদারও যুক্তরাষ্ট্র। মুসলিম অন্যদেশগুলো কিন্তু সৌদির বন্ধু নয়। গত মঙ্গলবার এ এক্স এন টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্লাভায় জিজেক এসব বলেন।
তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মুখপাত্র আহমেদ বেনচেমসি বলেন, “শুরু থেকে এখন পর্যন্ত মামলাটি নিয়ে গোপনীয়তা অবলম্বন করেছে সৌদি আরব। মুখোশ পরিহিত অভিযুক্তদের পরিচয় আমরা জানি না, কার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ আনা হয়েছে তাও জানি না।” স্লাভায় জিজেক বলেন, “সৌদি আরব চীনের উইঘুর নীতি সমর্থন করেছেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগত গণহত্যায় সরাসরি সমর্থন না দিলেও চুপচাপ ছিলেন। কাশ্মীরের বিষয়ে নিশ্চুপ। দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েল নীরব গণহত্যা পরিচালনা করলেও আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে মেনে নিয়েছে। সুদান, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়ার ব্যাপারে সৌদি আরবের মনোভাব বিরুপ।”
মুসলিম বিশ্বের পবিত্র দুইটি স্থানের অভিভাবক হিসেবে মুসলিম বিশ্বের বন্ধু হবার দাবীদার। কিন্তু দশকের পর দশক সৌদি রাজবংশ নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দূরে থাক, বরং মুসলিম বিশ্বে বিভক্তি এবং যুদ্ধ সৃষ্টির জন্য সৌদি আরবই অনেকাংশে দায়ী। লেবানন, সিরিয়া, মিশর, ইয়েমেন, লিবিয়া, কাতার এবং ইরাকে অস্তিরতার দায় সৌদি আরব এড়াতে পারে না। ২০১৩ সালে মিশরের প্রেসিডেন্ট মুরসিকে অপসারণে ইসরাইলের সাথে একযোগে কাজ করার অভিযোগ আছে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে। মুরসিকে সরাতে কোটি কোটি ডলার অর্থ ব্যয় করার পেছনে কারণ হচ্ছে, সৌদি রাজবংশ মনে করে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুড শক্তিশালী হলে সৌদি রাজবংশের দিন ফুরিয়ে আসবে। মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বে সৌদি আরবে আরব বসন্ত ঘটলে সৌদ রাজবংশ বিদায় নেবে। তাই কয়েকহাজার মুরসি সমর্থক হত্যাকে সৌদি আরব নীরব সমর্থন দেবে, এটাই ঘটেছে।
সিরিয়ার যুদ্ধে বিদ্রোহীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছে সৌদি আরব। গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়া। লিবিয়ার একটি পক্ষকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়েছে সৌদি আরব। গাদ্দাফির সাজানো ফুলের বাগানের মতো লিবিয়া এখন একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইরান আলোচিত নাম। মুসলিম বিশ্বে ইরানের তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তেহরানের সামরিক শক্তির দিকটি স্বীকৃত। কিন্তু আন্তর্জাতিক অবরোধে ইরান জর্জরিত। দেশটির অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা চাপ মোকাবিলার পাশাপাশি আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ রিয়াদকেও সামাল দিতে তেহরানকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও অভ্যন্তরীণ প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের নানান সংকটে তেহরানের কণ্ঠ উচ্চকিত। কিন্তু শিয়া রাষ্ট্র হওয়ায় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের জায়গাটি নিজের করে নিতে পারছে না ইরান।
তুরস্কে এরদোয়ানের জোর প্রচেষ্টায় ইতিমধ্যে ইসলামিক বিশ্বে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আঙ্কারা। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার পর তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের অবস্থান আরো সুসংহত হয়েছে। অধিকতর সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি। এখন তো তাঁকে অনেকে তুরস্কের নতুন সুলতান সুলেমান বলেও অভিহিত করেন। এরদোয়ান শুধু নিজ দেশের সুলতান হতে চান না; তার লক্ষ্য আরো বড়। তিনি মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে চান। এই লক্ষ্য থেকেই ইসলামি সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) বিভিন্ন ফোরাম ও উপলক্ষে এরদোয়ান নিজের যোগ্যতা তুলে ধরছেন। এই যেমন ২০১৬ সালের এপ্রিলে তুরস্কে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে এরদোয়ান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “আমি সুন্নি বা শিয়া নই, আমার ধর্ম ইসলাম।”
এরদোগান বেশ কৌশলী। যেমন, সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে একের পর রহস্য ঘনিভূত হচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগান নানা বক্তব্য দিলেও বাদশাহ সালমানের প্রশংসা করেছেন। সৌদি আরব যখন জামাল খাসোগিকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন তখন এরদোগান বলেছিলেন, “বাদশাহ সালমানের সত্যবাদিতা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই আমার কাছে।” এরদোগানের মুখপাত্র সৌদি আরবকে একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ, ভাতৃপ্রতিম দেশ’ বলে মন্তব্য করেছেন। জামাল খাসোগির ঘটনায় সৌদি আরবে গ্রেফতার ১৮ জনকে তুরস্কের কাছে হস্তান্তরের আহ্বান জানালেও এরদোগানের সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে রিয়াদ।
অন্যদিকে তুরস্ক সরকারের সমর্থক বিভিন্ন গণমাধ্যমে সৌদি আরবের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য নানা প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। ওইসব প্রতিবেদনে ক্ষমতাধর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে দায়ী করা হচ্ছে। সে কারণে সৌদি আরবের সঙ্গে তুর্কি প্রেসিডেন্ট আসলে কী খেলা খেলছেন, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তুরস্কে কর্মরত বিবিসির সাংবাদিক মার্ক লোয়েন একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি যতটুকু জানতে পেরেছেন, এই বিষয়ে এরদোগানের সংযত কণ্ঠের কারণ সৌদি আরবকে এটা বোঝানো যে, বিষয়টি তুরস্ক ও সৌদি আরবের সম্পর্কে অবনতি ঘটাবে না। দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন চলতে থাকলেও এই মুহূর্তে সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো উদ্দেশ্য তুরস্কের নেই। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তুর্কি প্রেসিডেন্ট এখনো পর্যন্ত সৌদি বাদশাহ বা যুবরাজের বিষয়ে কোনো নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। তিনি বরং এ বিষয়ে সৌদি বাদশাহর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বিবিসির এই সাংবাদিক মন্তব্য করেন, তুরস্ক এখন যে কৌশল নিয়ে আগাচ্ছে তা হলো, সৌদি বাদশাহ সালমান ও তার পুত্রের মধ্যে একটি বিভাজন তৈরি করা। তবে এই উদ্দেশ্য সফল করতে পারে শুধুমাত্র ওয়াশিংটন। ৮২ বছর বয়সী বাদশাহ তার পুত্রকে ক্ষমতা থেকে দূরে সরিয়ে দেবেন, এমনটা মনে করার কোনো কারণই নেই। কিন্তু আমরেকিা কি চাইবে সৌদির রাজবংশের মধ্যে বিভাজন টানতে? মোটেই না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি স্বার্থ রক্ষা করে সৌদি আরবই। সম্প্রতি স্লাভয় জিজেকও সেকথাই আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন।