পরিসংখ্যানই যার দ্যুতির জানান দেয়
ওয়াসিম আকরামের সেই ‘সেরাদের সেরা’ আজ পা রাখছেন ৪২ বছরে। ১৯৭৬ সালের আজকের দিনে লাহোরের পাঞ্জাবে জন্ম নেন ‘দুসরা’ বলের জনক সাকলাইন মুশতাক। ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি স্পিনারদের একজন এই পাকিস্তানি ডানহাতি অফ-ব্রেক বোলার ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত খেলেছেন ৪৯টি টেস্ট ও ১৬৯টি ওডিআই ম্যাচ। ১০০, ১৫০, ২০০ ও ২৫০ ওয়ানডে উইকেট শিকারে তিনিই ছিলেন দ্রুততম। ২০৮ টেস্ট আর ২৮৮ ওডিআই উইকেটের মালিক সাকলাইনের ঝুলিতে রয়েছে একটি টেস্ট সেঞ্চুরিও।
সরকারি কেরানির বাড়িতে জন্ম নেওয়া মুশতাক স্কুল পর্যায়ে ক্রিকেট খেলতে পারেননি কখনোই। লিকলিকে গড়নের মুশতাকের ঝোঁক সবসময়ই ছিল স্পিন বোলিংয়ে। অতঃপর ১৪ বছর বয়সে যোগ দেন লাহোরের সরকারি এমএও কলেজে। মুমতাজ আখতার বাট-এর কোচিংয়ে মুশতাকের দল জিতে নেয় টানা তিনটি চ্যাম্পিয়নশিপ।
সাকলাইনের প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে। ১৭ বছর বয়সে নিজের প্রথম মৌসুমেই তিনি তুলে নেন ৫২ উইকেট আর জায়গা করে নেন জাতীয় দলের নির্বাচকদের রাডারে। সেবছরই ডাক পড়ে পাকিস্তান ‘এ’ দলের ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য এক টুর্নামেন্টের স্কোয়াডে। এরপর পিসিবি প্যাট্রন একাদশের হয়ে সফররত লঙ্কানদের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী বোলিংয়ে সাকলাইন পান ৭ উইকেট।
সেপ্টেম্বরে জাতীয় দলের হয়ে টেস্ট আঙ্গিনায় অভিষিক্ত হন তিনি। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজে ৯ উইকেট—বেশ ভালোভাবেই শুরু হয় লাল বলের ঝলক। লঙ্কানদের বিরুদ্ধে পরের সিরিজে আরো জ্বলে ওঠেন সাকলাইন, সিরিজসেরা বোলার হন সর্বমোট ১৪ উইকেট নিয়ে। ৬ মাস পর রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট শিকার করার পর উইন্ডিজদের বিরুদ্ধে ৩য় টেস্টে ৮০ রান খরচে একাই তুলে নেন ৯ উইকেট। পরের সিরিজে তার কাছ থেকে নিস্তার পায়নি জিম্বাবুয়েও, ঘরের মাঠ লাহোরের গাদ্দাফিতে থামেন ৫ উইকেট নিয়ে।
তবে ক্রিকেটের দীর্ঘতম সংস্করণে সাকলাইন মুশতাকের সেরা সাফল্য আসে ১৯৯৯ সালের ভারত সফরে। এক ম্যাচে ১০ উইকেট লাভের গৌরব অর্জন করেন সেবারই। প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই পাঁচটি করে উইকেট ছিল। জয় থেকে মাত্র ১৭ রান দূরে থাকা ভারতের শেষ ভরসা সেঞ্চুরিয়ান টেন্ডুলকারের উইকেটটি তুলে বাজিমাত করেন মুশতাক। ফিরোজ শাহ কোটলায় সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচে যেন দেজা ভ্যু! পাঁচ-পাঁচ করে আবারও ১০ উইকেট লাহোরের এই জাদুকরের। তবে দলের পরাজয় ঠেকাতে পারেননি ২০.১৫ গড়ে ২০ উইকেট শিকার করা ম্যান অব দ্য সিরিজ মুশতাক। সেবছরের নভেম্বরে সাকলাইন নিজের খেল দেখান অস্ট্রেলিয়ায়। দুই টেস্ট মিলিয়ে পান ১০ উইকেট, ৪৬ রান খরচে যার ছয়টিই আসে হোবার্টে।
নতুন দশকের প্রথম সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠে অবশ্য উইকেট পেতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে, পাঁচ ইনিংসে উইকেট পান মোটে ৬টি। তবে নিজ শহরে ক্যারিয়ার-সেরা ফিগার দিয়েই স্বরূপে ফেরেন সাকলাইন মুশতাক। ১৬৪ রানের বিনিময়ে ইংলিশদের বিরুদ্ধে এক ইনিংসে নেন ৮ উইকেট। পরের বছর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭ আর তারপর জিম্বাবুয়ের মাঠে ১৫ উইকেট নিয়ে নিজের ঘূর্ণি জাদুর রেকর্ডটাকে সাকলাইন নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
২৯.৮৩ গড়ে ২০৮ উইকেট নেওয়ার পথে ১৩ বার গড়েছেন পাঁচ উইকেট নেবার কীর্তি। ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন সব মিলিয়ে তিনবার। ব্যাট হাতে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেননি, ৯২৭ রানের টেস্ট সিভিতে দুই ফিফটির পাশে জ্বলজ্বল করছে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হাঁকানো অপরাজিত সেঞ্চুরি।
১৯৯৫-এর সেই লঙ্কান সিরিজেই ওডিআইয়ের খাতা খোলেন সাকলাইন। অভিষেকে উইকেটশূন্য থাকা সাকলাইন ৩ উইকেট নিয়ে ম্যাচ-জয়ী পারফর্মেন্স দেখান ১৯৯৬ সালের সিঙ্গার কাপের ফাইনালে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে সেরা বোলিং ফিগার আসে ইংলিশদের বিপক্ষে, যেখানে পাঁচ উইকেট পান মাত্র ২০ রান দিয়ে। এই ফরম্যাটে পাঁচে পাঁচ পেয়েছেন আরো ৬ বার।
সাকলাইনের পরিসংখ্যানই তার দ্যুতির জানান দেয়। বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে তার ২১.৭৮ বোলিং গড় অবাক করেছে সবাইকে—যে ফরম্যাটে কিনা স্পিনারদের সীমানাছাড়া করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন ব্যাটসম্যানরা। ২০০তম ওডিআই উইকেট শিকারের আগ পর্যন্ত গড়ে ম্যাচপ্রতি প্রায় দুই উইকেট নিয়ে ছুটছিলেন মুশতাক। এ সংস্করণে দুটি হ্যাটট্রিকও আছে, যার দ্বিতীয়টি আবার বিশ্বকাপে কোনো পাকিস্তানি বোলারের প্রথম। এসব রেকর্ডেই প্রমাণ মেলে তৎকালীন পাকিস্তান স্কোয়াডে তার কার্যকারিতার। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস আর শোয়েব আখতারদের নিয়ে গড়া ত্রিফলা পেস আক্রমণের সাথে মুশতাকের দুসরার ছোঁয়া—বিশ্বসেরা বিধ্বংসী বোলিং লাইনআপ নিয়ে ছিল না তর্কের অবকাশ।
কাউন্টি দল সারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন টানা আট মৌসুম। সেই অধ্যায় শেষ হবার পরপরই জাতীয় দল থেকেও ছিটকে পড়েন সাকলাইন। তার দুসরা টেকনিক সহজে পড়ে ফেলছিলেন শেবাগ-দ্রাবিড়দের মতো চৌকস ব্যাটসম্যানরা, আর কার্যকরী বিকল্পের অভাবে মার খেয়ে যাচ্ছিলেন বারবার। অনেকের মতে, ঘন ঘন হাঁটুর ইনজুরি আর দলে নতুন স্পিনারদের জায়গা দিতে নিজ থেকেই সরে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। গুঞ্জন আছে, আমির সোহেল নির্বাচক হয়ে আসার পরপরই সিদ্ধান্ত নেন সাকলাইন-ইনজামামদের মতো সিনিয়রদের ছাঁটাই করার।
কাউন্টি ক্রিকেটে সব মনোযোগ ঢেলে পরবর্তীতে সাসেক্সের হয়ে খেলে গেছেন কিছু মৌসুম। তবে শেষমেশ আইসিএলে নাম লিখিয়ে নিষিদ্ধ হন আইসিসি সংশ্লিষ্ট যে কোনো ধরনের টুর্নামেন্ট বা লীগ থেকে, যার সাথে সাথে চিরতরে বন্ধ হয় জাতীয় দলে ফেরার স্বপ্নও।
পরবর্তীতে দুই মেয়াদে বাংলাদেশ ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্পিন বোলিং কোচ হিসেবে কাজ করা সাকলাইন মুশতাক ২০১৬ সালে কাজ করেছেন ইংল্যান্ড দলের স্পিন পরামর্শক হিসেবেও। মজার বিষয়, ২০০৪ সালে এক ইংরেজকে বিয়ে করে সেদেশের নাগরিকত্ব লাভ করা সাকলাইনের সামনে সুযোগ ছিল ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে পারফর্ম করার। তবে আনুষ্ঠানিক ডাক না পাওয়ায় একসময়ের ওই জোর গুঞ্জন পরে স্তিমিত হয়ে যায়।
২০০০ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব জেতা সাকলাইনের সোনালি ক্যারিয়ারটা আরো দীর্ঘ হলে রেকর্ডের পাতায় যে ঝড় বয়ে যেত, তা বলা বাহুল্য। এক সাঈদ আজমল বাদে পাকিস্তান দলে তার তেমন কোনো যোগ্য উত্তরসূরিও তৈরি হয়নি। তবে ৪২ বছর বয়সী মুশতাক যেভাবে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন নিজের ঘূর্ণি-দীক্ষা, তাতে বাইশ গজে অফ-স্পিনের রাজত্ব ভালোভাবেই ফিরে আসবে বলে বিশ্বাস ক্রিকেটপ্রেমীদের। জন্মদিনে এই কিংবদন্তির প্রতি রইল অনেক শুভেচ্ছা।