যে ধর্ষণের ঘটনায় ফুঁসে উঠেছিল গোটা তুরস্ক
সম্প্রতি রাজধানীর কুর্মিটোলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় বিচার দাবিতে উত্তাল হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশ। গত ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। এটাই যে প্রথম বা শেষ নয় পরিসংখ্যানই সেই ইঙ্গিত দেবে—শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই এদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১,৪১৩টি যা ২০১৮ সালে হওয়া ধর্ষণের দ্বিগুণেরও বেশি। ধর্ষণের শাস্তি কী হওয়া উচিত? অনেকেই মনে করেন ধর্ষকের লিঙ্গ কর্তন, কেউবা বলেন শাস্তি হওয়া উচিত প্রকাশ্য মৃতুদণ্ড। দুটোই খুব কঠিন শাস্তি। আর তা এই কারণেই—যাতে ধর্ষণকাণ্ডে জড়ানোর আগে মানুষ দশবার ভাবে। কয়েক বছর আগে এমনি একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল তুরস্কে।
ওজগেকান আসলান নামের ঊনিশ বছর বয়েসী এক তরুণীকে করা হয়েছিল ধর্ষণ। যে ছিল সাইকোলজির ছাত্রী। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়েটির চোখে বড় হওয়ার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সে চেষ্টাও করে যাচ্ছিল দিনরাত। স্কলারশিপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। তার দরিদ্র বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে টাকা উপার্জন করত তা দিয়ে ভরণ পোষণের পর অন্তত পড়ালেখার খরচ চলে না। পড়াশোনা করে তাই নিজের এবং বাবা মায়ের জীবন বদলে দেওয়ার স্বপ্নপূরণে সচেষ্টা আসলানের সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি একদল হায়েনা।
২০১৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ক্লাস শেষ করে বান্ধবীর সঙ্গে শপিংমলে গিয়েছিল। সেখান থেকে খেয়ে ফিরতে একটু দেরি হয়ে যায়। দু বান্ধবী মিলে উঠে যায় একটি মিনিবাসে। শহরের একের পর এক ল্যাম্পপোস্ট আর বাসস্টপ পেছনে ফেলে সব যাত্রী নামিয়ে বাস থামে আসলানের বান্ধবীর গন্তব্যে। বাসে থেকে যায় কেবল দুজন। আসলান আর বাসের ড্রাইভার। বাস ছুটতে থাকে আসলানকে নিয়ে। বাড়ি যাবে আসলান।
সারা সময় আসলানের বাবা মা অপেক্ষার চোখে তাকিয়ে থাকেন আসলানের ফেরার পথে। কিন্তু মেয়েকে আর দেখা যায় না। রাত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে অপেক্ষা, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ। মা বিলাপ করে কান্না শুরু করেন। ততক্ষণে আশেপাশে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আসলান ফেরেনি। যেই মেয়েটা সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলত, ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করত, মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগত যার, সমস্যা দূর করতে চাইত সকলের, সেই মেয়েই আজকে পড়ে গেছে সমস্যায়। সারা এলাকা তখন আসলানের জন্য পথ চেয়ে। কিন্তু আসলান কই?
রাতভর অপেক্ষা করে বিমর্ষ বাবা মা পরদিন থানায় রিপোর্ট করে। যোগাযোগ করা হয় আসলানের সেই বান্ধবীর সঙ্গে। সে সবশেষ তাদের বাসে একসাথে থাকার কথা বলে। পুলিশ তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী খুঁজতে থাকে বাসটি। গাড়ির নাম্বার বলতে না পারার কারণে তা খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। আশার আলো হয়ে আসে একটি চেকপোস্ট। এই শহরের সকল বাস ট্রাককে যে চেকপোস্টটি অতিক্রম করেই যেতে হয়।
অবশেষে চেকপোস্টে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া গেল এক অদ্ভুত তথ্য। তাদের ভাষ্য, গত রাতে তারা সেই বাস চেক করে বাসের মধ্যে রক্তের দাগ দেখতে পায়। বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করা হলে সে বলেছিল দুজন যাত্রী পরস্পর মারামারি করে এই রক্ত ঝরিয়েছে।
চেকপোস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বাসটি সনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ। বাসচালক সোফিকে দেখেই চিনে ফেলে আসলানের বান্ধবী। পুলিশ কাস্টডিতে যাওয়ার পরে সোফি দিতে থাকে ভুলভাল সব তথ্য। কিন্তু চাপের মুখে একপর্যায়ে স্বীকার করে নেয়—সারা বাসে একা একটি মেয়েকে দেখে তার মাথা বিগড়ে যায়। সে তখনই আসলানকে হেনস্থা করার একটা উপায় খোঁজে। গাড়ি যে রাস্তায় যাওয়ার কথা সে রাস্তায় না গিয়ে সে যেতে থাকে অন্য নির্জন রাস্তার দিকে। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে আসলানের ওপর।
আসলান ছিল সচেতন এক মেয়ে। একলা পথ চলতে গেলে যে বাধা-বিপত্তি আসতে পারে তার জানা ছিল। তাই সে সঙ্গে রাখত পিপার স্প্রে। সোফি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই লোকটার মুখের ওপর সরাসরি স্প্রে করে দেয় সে। এতে উত্তেজিত হয়ে কোমরে থাকা ছুরি বের করে উপুর্যুপরি কোপাতে থাকে সোফি। এতেই ক্ষ্যান্ত হয় না। আসলানের মাথায় উপুর্যুপরি আঘাত করতে থাকে। মেয়েটা নিজেকে রক্ষা করতে সকল চেষ্টা করে যায় শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত। তার হাজার কাকুতি মিনতিও ধর্ষকের মন গলাতে পারে না।
অন্যদিকে মুহুর্মুহু প্রতিরোধে বিকৃত কাম চরিতার্থ করতে না পারা সোফির হিংস্র মন অন্য উপায়ে জিততে চায়। আসলানের মাথায় লাগাতার আঘাত করতে থাকে। এভাবে একসময় পুরোই থেতলে দেওয়া হয় আসলানের মাথা। রক্ত গড়িয়ে পড়ে সারা মেঝেতে। নিজের সম্মান রক্ষা করতে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে হাজার স্বপ্ন বুকে নিয়ে বড় করুণ মৃত্যুকে বরণ করে নেয় আসলান। তবু একটা অমানুষের কাছে নিজেকে হারতে দেয় না সে।
আসলানের নিথর দেহ সোফি লুকিয়ে রাখে জঙ্গলে। একাজে তাকে সহায়তা করে তার বাবা ও এক বন্ধু। পুলিশ সোফিকে নিয়ে সেই জায়গায় গেলে দেখা যায় আলামত নষ্ট করার জন্য তারা আসলানের থেতলানো মুখমণ্ডলটি পুড়িয়ে ফেলেছে। মৃত্যুর আগে সোফির সাথে ধস্তাধস্তি হয়েছিল, আসলানের হাতে বা নখে আলামত লেগে থাকতে পারে যা থেকে পুলিশ তাদের সনাক্ত করতে পারে। এই আশঙ্কায় পোড়ানোর আগে আসলানের হাত দুটো কেটে আলাদা জায়গায় পুঁতে ফেলা হয়।
পরদিন সারাদেশে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে নাগরিকদের পক্ষ থেকে আসতে থাকে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের দাবি। দেশের সকল আইনজীবী আসামির হয়ে আইনি লড়াই করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে একজন যিনি রাজি হন তিনি আইনজীবী ও সোফির আত্মীয়। লাশ উদ্ধারের পর ময়না তদন্তে দেখা যায় আসলানকে ধর্ষণের চেষ্টা করেও সফল হয়নি ঘাতক। জীবন দিয়ে হলেও আসলান রক্ষা করেছে আত্মসম্মান। সারাদেশের মানুষ তখন আসলানের পরিবারের পাশে দাঁড়ায়।
আদালতে তোলা হয় আসামীদের। বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্ন বয়ান দিলেও শেষমেশ দোষী সাব্যস্ত হয়। কিন্তু তুরস্কের আইনে যেহেতু মৃত্যুদণ্ড নেই, তাদের যাবজ্জীবন হয়। জেলের ভেতরেই তারা হয়ে থাকে নিগৃহীত। বাকি কয়েদিরা তাদের উপস্থিতি মেনে নিতে পারে না।
তারপর ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিল যা হয় তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। গুলতেকিন আলান নামের পঞ্চাশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদি বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে গুলি করেন ধর্ষক সোফি ও তার বাবাকে। বাবা বেঁচে গেলেও মৃত্যু হয় সোফির। চার-পাঁচ দিন লাশ পড়ে রইল মর্গে। কারণ সোফির এলাকাবাসী এমন ঘাতক নরপশুকে নিজেদের এলাকায় মাটির নিচেও শুয়ে থাকতে দেবে না বলে একতাবদ্ধ হয়। ধর্ষক সোফির মা হাজার অনুনয় করলেও এলাকাবাসী তা মানতে নারাজ। ফলে পুলিশি পাহারায় পরে অন্য এলাকায় খুব গোপনে তার দাফনকার্য সম্পন্ন হয়।