১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসা ও বসন্ত বন্দনা
বদলে গেছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। এতদিন বসন্তবরণের পরদিন আগমন ঘটতো ভালোবাসা দিবসের। তবে এবার নতুন সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে ফাল্গুনের প্রথম দিনেই উদযাপিত হবে ভালোবাসা দিবস। ১৪০১ বঙ্গাব্দে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদ্যাপন করার রীতি চালু হয়। এরপর থেকে বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা ফাল্গুন অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘ফুল ফুটুক না আর ফুটুক আজ বসন্ত’।
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর এবার ১৪ ফেব্রুয়ারি একই দিনে গলাগলি করে হচ্ছে বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসের উদযাপন।
ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে শীতের ধূসরতা সরিয়ে প্রকৃতি সেজেছে রঙিন সাজে। গাছের শাখায় জেগে উঠেছে নতুন পাতার সবুজ কুঁড়ি। শিমুল-পলাশ বনে রঙিন ফুলের সৌরভ। মৃদু দখিনা বাতাসে দোল খাচ্ছে প্রকৃতি। কোথাও কোথাও ঋতুরাজকে বরণ করে নিতে কুহু স্বরে ডেকে উঠছে কোকিল। তাই বসন্তকে বরণ করে নিতে কবি গুরুও বলেছেন দেরি না করতে, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/ কোরো না বিড়ম্বিত তারে’।
নগরবাসীও প্রস্তুত বসন্ত আর ভালোবাসাকে একইসঙ্গে বরণ করে নিতে। বাসন্তী রঙের সাজে, হরেক ফুলের বাহারে তরুণ-তরুণীর সাজপোশাকে রাজধানীসহ সারা দেশে রব উঠবে— আহা আজি এ বসন্তে….।
বসন্তের দিনটিতে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হওয়ায় যোগ হয়েছে বাড়তি উৎসব। ঋতুরাজকে বরণ করার পাশাপাশি তরুণ-তরুণীরা রাখ-ঢাক না রেখে মন-প্রাণ উজাড় করে প্রিয়জনকে বলবে, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি’।
বাংলা বর্ষ পঞ্জিকা পরিবর্তনে বসন্ত উৎসব নিয়ে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি’ সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই জানেন না বদলে গেছে বাংলা বর্ষপঞ্জি। তাই বাংলা পঞ্জিকা না দেখে অনেকেই ১৩ ফেব্রুয়ারি সকালে বের হয়েছেন বসন্ত উৎসবে যোগ দিতে। এ দিন সকাল থেকে রাজধানীর পথে-ঘাটে, বইমেলায় তরুণ-তরুণীদের বাসন্তী রঙের শাড়ি ও খোঁপায় ফুলে গুঁজে বের হতে দেখা গেছে।
১৯৭১ সালের কয়েকটি ঐতিহাসিক দিনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি। যার ফলে ইংরেজি দিন ঠিক থাকলেও কিছুটা এদিক সেদিক হয়েছে বাংলা মাসের তারিখ। নতুন এই বর্ষপঞ্জিতে জাতীয় দিবসের বাংলা তারিখ এখন থেকে একই থাকবে প্রতিবছর।
তবে সাধারণ মানুষের দাবি, বাংলা একাডেমি যে পঞ্জিকা পরিবর্তন করেছে এ নিয়ে তেমন প্রচারণা ছিল না। মানুষ জানেই না ১৪ ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন। তাই না জেনে বসন্ত উৎসব পালন করছে মানুষ।
পহেলা ফাল্গুন নিয়ে জনমনে ‘বিভ্রান্তি’ প্রসঙ্গে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক কাজী আনিস বার্তা২৪.কমকে বলেন, বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তনের বিষয়টি হয়ত অনেকেই জানেন না, তবে এজন্য এককভাবে বাংলা একাডেমিকে দোষ দেওয়া যাবে না। এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ, বাঙালি হিসেবে বর্ষ পঞ্জিকা জানাটা আমাদের নিজেদের দায়িত্ব। পরিবার থেকে অনেক সময় এসব শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। আমরা সাধারণত ইংরেজি তারিখটাকেই প্রাধান্যে রেখে বাংলার উৎসবগুলোও মনে রাখি। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার, নিজ উদ্যোগে এ বিষয়গুলো জানতে হবে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদের সভায় ২০২০ সালের সরকারি ছুটির তালিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছুটির তালিকা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ কয়েকটি জাতীয় দিবসের বাংলা তারিখে পরিবর্তন এসেছে।
বাংলা বর্ষপঞ্জি
বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের কাজ করেছে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ। এই বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাস ৩১ দিন, কার্তিক থেকে মাঘ মাস ৩০ দিন এবং ফাল্গুন মাস ২৯ দিন ধরে গণনা করা হবে। তবে গ্রেগরীয় পঞ্জিকার অধিবর্ষে (লিপ ইয়ার) ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিন গণনা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাই সেভাবেই সাজানো হয়েছে নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি।
বাংলা একাডেমি জানায়, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দিনগুলো, যেমন- ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ নজরুল জন্মজয়ন্তী ও রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর বাংলা তারিখ সংশোধন করা হয়েছে। পঞ্জিকার এই সংশোধনের ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিসঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ৮ ফাল্গুন, যা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও ছিল ৮ ফাল্গুন। স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চের প্রতিসঙ্গী তারিখ হবে ১২ চৈত্র, যা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসেও বাংলা তারিখ ছিল ১২ চৈত্র। একইভাবে নজরুল জন্মজয়ন্তী ২৫ মে’র প্রতিসঙ্গী তারিখ ছিল ১১ জ্যৈষ্ঠ ও বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বরের প্রতিসঙ্গী বাংলা তারিখ ছিল পহেলা পৌষ। এসব দিবসে বাংলা ও ইংরেজি তারিখের মিল রেখে সংশোধন করা হয়েছে বাংলা বর্ষপঞ্জি।
বাংলা একাডেমির সংশোধিত এই বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে আগের মতোই ১৪ এপ্রিল থেকেই বাংলা বর্ষ গণনা শুরু হবে। অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ ঠিক থাকছে।