বাংলা সন সংস্কার এবং প্রাসঙ্গিক নানা কথা
সম্প্রতি বাংলা ক্যালেন্ডারে পরিবর্তনের ঘটনা বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে জনমনে। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি সেই আলোচনায় দেয় নতুন রসদ। দীর্ঘদিনের ধারাবাহিকতায় উক্ত দিনেই পহেলা ফাল্গুন পালিত হবার কথা। কিন্তু ২০২০ সালের সংশোধিত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পালিত হলো ১৪ তারিখ।
পরিবর্তন প্রচলিত হয়েছে এ বছর অর্থাৎ ১৪২৬ বঙ্গাব্দের প্রথম থেকেই। পূর্ব নীতি অনুসারে নির্ধারণ করার কারণে এতদিন টের পাওয়া যায়নি। অবশ্য এই সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন শামসুজ্জামান খান। এরও আগে কয়েক দফা সংস্কার ও সংশোধন পার করে এসেছে আজকের বাংলা সন। বাংলা সনের আদ্যোপান্ত নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
সংস্কারের ইতিহাস
১৯৫২ সালে প্রথম বাংলা ক্যালেন্ডার নিয়ে আলাপ ওঠে। প্রখ্যাত জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং তার কমিটি ভারতের অন্যান্য সালের সাথে বাংলা সনেও সংশোধনের প্রস্তাব আনেন। ভারত সরকার তাঁর প্রস্তাব গ্রহণ করে ১৯৫৭ সালে। সেই সংশোধনের কথা মাথায় রেখেই ১৯৬৩ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বাংলা ক্যালেন্ডার সংস্কারের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলাদেশ জন্মের পর তাজউদ্দিন আহমদ সরকারি নথিতে বাংলা তারিখের প্রথা চালু করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে তা আরো দৃঢ় হয়। অবশেষে ১৯৮৭ সাল থেকে সরকারি কাজে খ্রিস্টাব্দ ব্যবহারের পাশাপাশি বাংলা সন লেখার নির্দেশনা আসে।
বাংলা ক্যালেন্ডার আধুনিকায়নে মেঘনাদ সাহা এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র ভূমিকা অগ্রগণ্য; শহীদুল্লাহ কমিটির প্রস্তাবনাতেও পরিবর্তন আনা হয় পরবর্তীতে। ১৩ আগস্ট, ১৯৯৫ এবং ১৯ আগস্ট, ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে পরপর দুই দফায় প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। সংস্কারের প্রস্তাবগুলো নিম্নরূপ—
১. সাধারণভাবে বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাসে ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিন গণ্য করা হবে।
২. গ্রেগরিয় বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে যে বাংলা বছরের ফাল্গুন মাস পড়বে সেই বাংলা বছরের অধিবর্ষ গণ্য করা হবে।
৩. অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস হবে ৩১ দিনে।
৪. আন্তর্জাতিক রীতি মোতাবেক রাত ১২টায় তারিখ পরিবর্তিত হবে।
(বাংলা সন ও পঞ্জিকার ইতিহাস-চর্চা এবং বৈজ্ঞানিক সংস্কার, পৃষ্ঠা-১১৯)
নতুন নিয়ম
বর্তমান সংশোধনের মধ্য দিয়ে আরেক দফা পরিবর্তিত হলো বাংলা ক্যালেন্ডার। এই মতানুসারে—
১. সাধারণভাবে বৈশাখ থেকে আশ্বিন অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম ছয় মাস পালিত হবে ৩১ দিনে। বলা বাহুল্য আগে যেখানে বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনে গণনা করা হতো।
২. ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস গণনা করা হবে ৩০ দিনে।
৩.ফাল্গুন মাস পালিত হবে ২৯ দিনে। শুধুমাত্র লিপ ইয়ারের বছরে ফাল্গুন মাস ৩০ দিন গণ্য হবে।
বাংলা একাডেমির এই উদ্যোগ পরবর্তী বর্ষগণনাকে বদলে দেবে
নতুন এই সংশোধনের কারণে জাতীয় দিবসগুলো বাংলা ক্যালেন্ডারে যে দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল; সেই দিনেই পালন করা যাবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিনটি ছিল বাংলা ৮ই ফাল্গুন। এই সংশোধনের জন্য তা প্রতিবছর ৮ই ফাল্গুনেই পড়বে। আবার ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিনটি ছিল বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১লা পৌষ। এতদিন তা ২রা পৌষে পালিত হলেও এখন থেকে পালন করা যাবে ১লা পৌষেই। একইভাবে পালিত হবে ২৬ মার্চের মতো অন্যান্য দিনগুলো।
বাংলা সনের প্রবর্তন প্রসঙ্গ
ইতিহাস অনুসারে বাংলা অব্দের প্রচলন মোঘল সম্রাট জালালউদ্দিন মোহম্মদ আকবরের আমলে। খাজনা আদায়ের সুবিধার কথা মাথায় রেখে স্থানীয় আবহাওয়ার সাথে সম্পর্কিত একটা পঞ্জিকা প্রচলনের প্রয়োজন দেখা দেয়। সভার জ্যোতির্বিদ আমির ফতুল্লাহ শিরাজি উদ্ভাবন করেন পথ। ১৫৮৪ সালে জন্ম নেয় তারিখ-ই-ইলাহি নামে নতুন সাল। গোড়া ধরা হয় ১৫৫৬ সালে; অর্থাৎ আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছর। সন প্রবর্তনের বছরটি ছিল ৯২৩ হিজরি। বাংলা সন শুরুই হয় ৯২৩ সাল থেকে।
১৭০০ সালে বাংলার দেওয়ান হিসাবে নিয়োগ পান মুর্শিদকুলী খান। রাজস্ব এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে দেন দূরদর্শিতার পরিচয়। সেবার তাকে বাংলা থেকে সরিয়ে ফেলা হলেও ১৭১৬ সালে নাজিম পদে উন্নীত হয়ে ফিরে আসেন। ততদিনে মোগল সাম্রাজ্য স্তিমিত হয়ে পড়েছে ভেতরে ভেতরে। দিল্লির মসনদ দখলের জন্য উত্তরাধিকারীদের মধ্যে টানাপোড়েন তুঙ্গে। ১৭২২ সাল। টোডরমল এবং শাহ সুজার প্রবর্তিত ভূমিরাজস্ব পদ্ধতির সংস্কার করলেন মুর্শিদকুলী খান। প্রবর্তিত হলো মালজামিনী নামের ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় জমিদাররা কিছু সম্পত্তি জামিন রাখার মাধ্যমে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পেতে। রাজস্ব আদায়ে অপেক্ষাকৃত বিশ্বস্ততার কারণে হিন্দু জমিদার এবং অভিজাত শ্রেণি গড়ে ওঠে ঠিক এই সময়টাতেই।
বাংলা সন এবং আকবরের ইলাহি সনের মধ্যকার ঐতিহাসিক শূন্যস্থান পূরণে মুর্শিদকুলী খান গুরুত্বপূর্ণ। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই আকবর ইলাহি সনের প্রবর্তন করেন। সেই সনকে ভিত্তি ধরে ঠিক রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্যই মুর্শিদকুলী খানের সময় বাংলা সন জন্ম নেয়। এ কারণে মাসের ফারসি নামগুলো পরিবর্তিত হয়ে গেল নক্ষত্রের নামানুসারে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ... এভাবে। ইলাহি সন থেকে উৎপত্তি ঘটলেও বাংলা সালের মাস এবং দিনের নাম পূর্বপ্রচলিত শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে।