প্রহর শেষের আলোয় রাঙা চৈত্র মাস

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

চৈত্রে চিরায়ত বাংলা/ছবি: বার্তা২৪.কম

চৈত্রে চিরায়ত বাংলা/ছবি: বার্তা২৪.কম

সোমবার (১৬ মার্চ) ফাল্গুন শেষে শুরু হলো বসন্ত ঋতুর দ্বিতীয়-পর্ব চৈত্র মাসের। ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে প্রকৃতি। যদিও কবিগুরু বলেছিলেন, ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস/তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’

চৈত্রের প্রখর খরদাহ ও ঝড়ের তাণ্ডবতায় সর্বনাশের বাঁশি কখন যে বেজে ওঠে, কে জানে! তবুও চৈত্র মানে বসন্তের অপরূপ বৈভব। প্রকৃতির মাতাল আলোড়নের মাস চৈত্র।

বিজ্ঞাপন

প্রতি বছরের মতোই ফাল্গুনী বাহারে-চাঞ্চল্য শেষে আসে চৈতালী উন্মত্ততা। ঝড়ো হাওয়ায় শিলা বৃষ্টি তছনছ করে সারা দেশ। উতলা বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির মিলিত সঙ্গীতে ভিজে যায় গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের যাবতীয় নান্দনিক বিন্যাস। প্রকৃতিতে তাণ্ডবতার প্রচ্ছন্ন ছাপ ফেলে ঝরে পড়ে নব-অঙ্কুরিত আমের মুকুল, কচি শাখা, সতেজ পত্রালী। তথাপি চৈত্র ধ্বংসের চিহ্নে অঙ্কিত হয় জীবনেরই আলপনা।

প্রকৃতি ও পরিবেশের আবহমানতায় বাংলাদেশে চৈত্র মাস রুদ্র বৈভব নিয়ে আসে। রূপ-রঙ-সৌরভের স্মৃতিময় ফাল্গুনকে বিদায় জানিয়ে তাপ ও দহনের গতিবেগে আসে চৈত্র। চৈত্র জানান দেয় কালবৈশাখীর আগাম বার্তা। দিগন্ত ছেয়ে কালো মেঘের আনাগোনায় ঘোষণা করে নতুন বছরের নতুন মাস বৈশাখের পদধ্বনি। চৈত্রের রুদ্র দাপটে ক্রমেই শেষ হয় মৃদুমন্দ উদাসী হাওয়ার মখমল পেলব বাসন্তী দিন, স্বপ্নমেদুর রাত্রি আর রঙিন উৎসবময়তার চালচিত্র।

বিজ্ঞাপন

দিন আর রাত্রে দামাল বাতাসের ছন্নছাড়া প্রতাপে চৈত্র অস্থির করে যাপিত জীবন। তপ্ত, নিঃসঙ্গতায় খা খা করে চরাচর। ফেটে চৌচির হয় ভূমিতল। হঠাৎ ঝড়ো-বৃষ্টির ছোঁয়ায় কিছুটা জলমগ্ন হলেও নিজের রুক্ষতাকে মোটেও আড়াল করে না চৈত্র। নিদারুণ চৈত্র মাসে একেলা পাখিটিও স্তব্ধ হয়ে ভুলে যায় সুরেলা কূজন।

চৈত্রের গুমোট পরিবেশে না বলে চলে আসা ঝড়ের হাতছানিতে মনে পড়ে ভয়ঙ্কর সুন্দরকে। হলদে ধূসর শূন্যতার মাঝে কাটে চৈত্র-তাপিত বিষণ্ন জীবন। তাপদগ্ধ পাণ্ডুর অবয়বে চৈত্র টেনে নেয় প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবনকে; জীবনের যাবতীয় সবুজ ও সৌরভে মাখিয়ে দেয় তাণ্ডবতা।

চৈত্র যেন শুষে নিতে চায় জলমগ্ন জীবনের সজল সুষমা। খাল, বিল, নদী, নালা আসন্ন বর্ষায় ভরপুর হওয়ার আগে নিঃশেষ হয় চৈত্রের দহনে। কখনো তীব্র খরার করাল গ্রাসে গ্রামবাংলার সামান্য সবুজ আর শ্যামলকেও রেহাই দিতে চায় না। ঘর্মাক্ত শরীরে মানুষ এবং দূরতম নীলিমার হাহাকার-চিল তাকিয়ে দেখে প্রকৃতির সর্বনাশা তাণ্ডব।

রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এ উল্লেখিত যে বিখ্যাত উক্তি শুরুতে দেওয়া হয়েছে, কে জানে, ভরাচৈত্রে প্রেয়সীর চোখে কোন সর্বনাশের ছবি দেখে প্রিয়তম পুরুষ? হয়ত বলে, চৈত্রও ভালোবাসাকে রিক্ত হতে দেয় না। চৈত্রের দাবদাহ ও তাণ্ডবতাতেও যেমন প্রকৃতিতে লাল-আগুন জ্বেলে পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া জেগে থাকে, তেমনি জেগে থাকে অমরাবতীর পথ, ভালোবাসার সরণী। স্বচ্ছ জ্যোৎস্না, তারায় ভরা আকাশ আর সেই আকাশের নক্ষত্রখচিত আয়না ও আঁখিতারায় তো শুধু সর্বনাশই লিপিবদ্ধ হয় নি, রচিত হয় ভালোবাসার গুচ্ছগুচ্ছ বর্ণালীও।

রুক্ষ চৈত্র সব কেড়ে নিলেও ঝরা পাতাদের উল্লাসে ধরে রাখে বসন্তের কিছু কিছু স্মৃতি আর প্রেমের আকুতি। চৈত্র জাগ্রত রাখে ভালোবাসার প্রতীতি। সে ভালোবাসায় ‘সর্বনাশ’ লিখা থাকলেও তা মুছে দেয় মানব-মানবীর অন্তর্গত বেদনার নদী। হৃদয়ের গহীন-গভীরে কে কাঁদে প্রেমে ও ভালোবেসে, চৈত্র শুধু মানবীয় রহস্যের সে কথাটি জানে!