পরিবেশ দূষণ: করোনা ভাইরাসের চেয়েও প্রাণঘাতী
নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯), বর্তমানে সারাবিশ্বে মহা আতঙ্কের এক নাম। ইতোমধ্যে করোনায় বিশ্বে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ছাড়িয়েছে এবং সংখ্যাটা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা কি জানি এর চেয়েও বড় প্রাণঘাতী সমস্যা হচ্ছে পরিবেশ দূষণ। এই বহুল পরিচিত বিষয়টি প্রাণঘাতীও বটে। এয়ার ভিজ্যুয়াল এর রিপোর্ট অনুযায়ী শুধু বায়ুদূষণের ফলে প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৭ মিলিয়ন মানুষের অকালমৃত্যু ঘটছে।
করোনাভাইরাস বর্তমানে মানুষের প্রাত্যহিক দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরিবেশ দূষণ মানুষের ওপর আরও বেশি মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। অথচ অধিকাংশ মানুষই এই ব্যাপারে গভীরভাবে ভাবে না। বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে।
গ্লোবাল এয়ার ২০১৯-এর তথ্য মতে ২০১৭ সালে বায়ু দূষণে বাংলাদেশে ১ লক্ষ ২৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। দূষিত বাতাসে নানা রকম ক্ষতিকর উপাদান থাকে যার কারণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানিসহ আরা নানারকম রোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। এয়ার ভিজ্যুয়াল এর রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ুদূষণ এখন অকালমৃত্যুর জন্য বিশ্বের চতুর্থ কারণ। বিষাক্ত ও সীসাযুক্ত গ্যাস ব্যবহার, যান্ত্রিক যানবাহন, ইটভাটা, শিল্প ও কলকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কৃষিজ বর্জ্য, খননের সময় খনির বর্জ্য বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ।
শিল্পায়ন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা ও বাসস্থানের জন্য প্রতিনিয়ত বন ধ্বংস করা হচ্ছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গত ৮ লাখ বছরেরও অধিক সময় থেকে এখন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই সময়েই বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ সব থেকে বেশি। আমরা জানি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ভূমিকা শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ। বর্তমান হারে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বৃদ্ধি পেলে গড় তাপমাত্রা বর্তমানে ১৫০ সেলসিয়াস থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ৩% বৃদ্ধি পেয়ে হবে ১৮০ সেলসিয়াস। এর ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১৭% স্থলভূমি সমুদ্রে জলমগ্ন হবে। ফলে জনসংখ্যার চাপে খাদ্যসংকট সৃষ্টি হবে এবং জলবায়ুর অধিক পরিবর্তন দেখা দেবে।
প্রাকৃতিক ফ্রিজার হিসেবে খ্যাত এন্টার্কটিকার গ্লেসিয়ার গুলোতে হাজার হাজার বছরের পুরনো মৃতদেহগুলো প্রায় অক্ষত অবস্থায় বরফের নিচে চাপা পড়ে আছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে বরফগুলো গলায় উন্মুক্ত হতে শুরু করেছে মৃতদেহগুলো। যে ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া গুলো এতো বছর সুপ্ত অবস্থায় ছিল সেগুলো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় বিজ্ঞানীরা।
জলবায়ু ও জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত ও সংবেদনশীল স্বাস্থ্যসমস্যা যেমন অপুষ্টি, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। প্রত্যেক বছর ডায়রিয়াতে প্রায় ৮ লক্ষ এবং অপুষ্টিতে প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ মারা যায়। সারা পৃথিবীতে অ্যানোফিলিস মশাবাহিত ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়ে প্রত্যেক বছর মারা যাচ্ছে প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু দ্রুত ছড়াচ্ছে। পরিবেশে এইসব সমস্যা ছাড়াও পানি দূষণ, মৃত্তিকা দূষণসহ আরো অনেক সমস্যাবলীর জন্যে বিশ্ব প্রতিনিয়ত হুমকির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ফলে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। এর ফলাফল ক্রমাগত সুস্পষ্ট হচ্ছে, এখনো সময় আছে কিন্তু খুব বেশি সময় নেই এখনি আমাদের প্রয়োজনীয় সতর্কতা এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
করোনারভাইরাস মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষের নেওয়া পদক্ষেপের কারণে বেশ কিছু দিনে ভাইরাস বিপর্যস্ত বিশ্বে পরিবেশের নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। আশা করা যায় বিশ্ব দ্রুতই করোনার অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে। তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার অভিযান যেন বন্ধ না হয়ে যায়। স্বাস্থ্যসম্মত, দূষণমুক্ত পরিবেশ আমাদের সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর জীবন এর জন্য অপরিহার্য।
তথ্যসূত্রে: এয়ার ভিজুয়াল, বিশ্বব্যাংক, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ, বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা, এএফপি, বিবিসি
লেখক: