সুপারবাগ: অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু
কোনো সংক্রমণ ছাড়া বেশি অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ালে প্রাণীদেহের জীবাণু ধীরে ধীরে সেই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে ফেলে। ফলে মানুষ যখন এভাবে উৎপাদিত গরু, মুরগি বা মাছ খায় তখন খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু প্রবেশ করে। এরপর মানুষ যখন নিজের অসুস্থতায় সেসব অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে, সেই ওষুধে আর কোনো কাজ হয় না। আর এসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘সুপারবাগ’ নামে অভিহিত করেছেন।
সুপারবাগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিষ্কার খুলে দিল ব্যাকটেরিয়া বধ করার পথ। পেনিসিলিন পরবর্তী যুগে আমরা বিভিন্ন গ্রুপের অসংখ্য কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক পেয়েছি, যা হরেকরকম জীবাণুনাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে। তারপর শুরু হলো আসল বিপর্যয়। এর প্রধান কারণ হলো মেথিসিলিন রেজিস্ট্যান্ট স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াস (MRSA) নামক জীবাণুর প্রাদুর্ভাব, যার বিরুদ্ধে পেনিসিলিন গ্রুপের সবচেয়ে কার্যকর ও শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক মেথিসিলিনের অকার্যকারিতা। মেথিসিলিন রেজিস্ট্যান্ট স্টেফাইলোকক্কাস অরিয়াসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রামক রোগ ও অ্যান্টিবায়োটিক যুগের এক মহাবিপর্যয়ের সূত্রপাত হয়ে গেল। ২০১৩ সালে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ১৮টি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর তালিকা প্রকাশ করে, যা মানবসভ্যতার জন্য এক মহাহুমকি ও অশনিসংকেতের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তারই ফলে আমরা পেলাম অ্যাটম বোমাসম অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্ট জীবাণু, যাকে সুগারবাগও বলা হয়।
গনোরিয়াসহ কিছু সাধারণ রোগ চিকিৎসায় একসময় পেনিসিলিন অত্যন্ত কার্যকর ওষুধ ছিল। পেনিসিলিন যখন অকার্যকর হয়ে গেল তখন বাজারে এলো সাড়া জাগানো টেট্রাসাইক্লিন। টেট্রাসাইক্লিন অকার্যকর হতেও বেশি সময় লাগল না। তখন এলো ক্লোরোকুইনোলন গ্রুপের সিপ্রোফ্লক্সাসিন, নালিডিক্সিক এসিড, ল্যাভোফ্লক্সাসিন জাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক। দোর্দণ্ড প্রতাপে জীবাণুকে পরাস্ত করল বেশ কয়েক বছর ধরে এই ডাকসাইটে অ্যান্টিবায়োটিক। জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে একসময় এই ক্ষমতাধর ওষুধেরও অপমৃত্যু ঘটল। একসময় ভীষণ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করলেও এখন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে সেফালোস্পোরিন গ্রুপের বেশিরভাগ অ্যান্টিবায়োটিক। এখন কিছু কিছু জীবাণুকে পরাস্ত ও ধ্বংস করা সম্ভব হচ্ছে সেফট্রিয়াক্সন ও অ্যাজিথ্রোমাইসিনের কম্বিনেশন অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। তাও কতদিন কার্যকর থাকবে বলা মুশকিল।
যেভাবে সুপারবাগ কাজ করে
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার নয় বলে এই সমস্যাকে আমরা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করতে পারছি না।
প্রথমত, জীবাণুর বিশেষ কোনো এনজাইম অ্যান্টিবায়োটিকের গাঠনিক সংকেতে এমন কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে, যার কারণে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, অনেক সময় জীবাণু এমন সব এনজাইম তৈরি করে যা অ্যান্টিবায়োটিকের গাঠনিক সংকেতকে ভেঙে দিতে সক্ষম।
তৃতীয়ত, কোনো কোনো জীবাণু আছে যা জন্মগতভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল নয়। যেমন; গ্রাম-নেগেটিভ জীবাণুগুলোর কোষপ্রাচীর এমন জটিলভাবে তৈরি, যার বিরুদ্ধে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়।
চতুর্থত, জেনেটিক মিউটেশনের (জিনের রাসায়নিক পরিবর্তন) মাধ্যমে অনেক জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে। কোটি কোটি জীবাণুর মধ্যে যেকোনো একটি জীবাণু যদি মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে যায়, সেই জীবাণু পরবর্তী সময়ে বংশবৃদ্ধি ও বিস্তারের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এসব জীবাণু পরিবর্তিত জিনকে অন্য জীবাণুতে স্থানান্তর করার মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্ট জীবাণুর ব্যাপক বিস্তার ঘটায়। এসব জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত কোনো রোগী তখন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দ্বারা সংক্রমণমুক্ত হয়ে আরোগ্য লাভ করে না। ফলে রোগী অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুৎফর কবির বলেন, আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তার অনেকগুলো থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে। যেমন—মুরগির মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছেও হরমোন ব্যবহার করা হয়; সেখানেও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় রোগ-প্রতিরোধ করার জন্য, শাক-সবজিতে যদিও সরাসরি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় না। তবে কীটনাশক দেওয়া হয়।
কিভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?
উৎপাদন প্রক্রিয়াতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রোধ করতে হবে। সাধারণ মানুষের সচেতনতার ওপর গুরুত্ব দিলেও মূল কাজটি করতে হবে রাষ্ট্রকেই। খাবারের মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যেন বাজারে বিক্রি করা খাদ্যদ্রব্যে অ্যান্টিবায়োটিক না থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লুৎফর কবির আরো বলেন, পরিস্থতি আতঙ্ক তেরির মতো নয় আবার হেলাফেলা করাও যাবে না। সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, একটা সময় সরকারি পর্যায়ে ফরমালিন নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং সেটি বন্ধ হয়েছে। ফরমালিন আমদানি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমরা জোর দিয়েছিলাম। এখন ফরমালিন নেই বললেই চলে কারণ সেটি আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। খোলাবাজারে ফরমালিন বিক্রি বন্ধ করা গেছে। এভাবে পশু-প্রাণীর খাদ্যে সরকার চাইলে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারও বন্ধ করতে পারে। যেসব উৎস থেকে অ্যান্টিবায়োটিক সংগ্রহ করা হয় সেসব স্থান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর চাইলে এটা মনিটরিং করতে পারে। আর সচেতনতা তৈরি করতে হবে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও যারা তাদের পালিত পশু-প্রাণীকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ান।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমানের পরামর্শ, অনেক ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ট্যাবলেটের মতো পুরো কোর্সের হিসাবে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ একটি বোতল বা প্যাকেটে রেখে বিক্রি করা যেতে পারে, যাতে খোলা একটা-দুইটা না কেনা যায়। আর সরকারি হাসপাতালে তাদের দৈনিক বরাদ্দ অনুযায়ী যে কয়জনকে সম্ভব যেন পুরো কোর্সের ঔষুধই দেওয়া হয়। তাঁর মতে, অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের কোর্সের আংশিক দেওয়ার চেয়ে না দেওয়া ভালো।
জনসতর্কতার জন্য স্ট্রিপে বা বোতলে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের নাম লাল রঙে লেখার পরামর্শ দিয়ে এ ফার্মাকোলজিস্ট বলেন, এ জন্য বাড়তি কোনো টাকা খরচ হবে না কারো। লাল রঙটি অ্যান্টবায়োটিকের জন্য রেখে তাদের লেবেলে ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। রঙ দেখেই সাধারণ মানুষ চিনতে পারবে, সতর্ক হবে। চিকিৎসকরাও প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক লাল রঙে লিখতে পারেন অথবা চিহ্নিত করে দিতে পারেন।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের যথেষ্ট ব্যবহারের জন্য শুধু ফার্মেসি বা রোগীকে দায়ী করলেই হবে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তথা চিকিৎসকদেরও আরো সচেতন হওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ আমাদের অনেকেরই শুরুতে হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার প্রবণতা আছে। এটিও খুব ক্ষতিকর একটা দিক।