এলিয়টের 'নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাস', জীবনানন্দের আশাবাদ



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি টি. এস. এলিয়ট, ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি টি. এস. এলিয়ট, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

ইউরোপে বসন্ত আনে এপ্রিল মাস আর বাংলায় এপ্রিলে আসে বসন্ত ও গ্রীষ্মের সন্ধিক্ষণ। আধুনিক ইংরেজি সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম কবি টি. এস. এলিয়ট (২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৮-৪ জানুয়ারি ১৯৬৫) এই এপ্রিলকে বলেছিলেন, 'নিষ্ঠুরতম মাস'। যা ছিল কবির কল্পনা, তা-ই শতবর্ষ পরে বাস্তবের কঠিনতম উপলব্ধিতে এসে হাজির হয়েছে। কারণ অসংখ্য মৃত্যু ও আক্রান্তের মাধ্যমে বৈশ্বিক মহামারিতে পর্যবসিত করোনাভাইরাস এক নিষ্ঠুরতম এপ্রিল মাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে পুরো পৃথিবীকে।

১৯২২ সালে বিখ্যাত কবিতাটিতে এলিয়ট বলেন,  April is the cruelest month, breeding Lilacs out of the dead land, mixing Memory and desire, stirring Dull roots with spring rain -T.S. Eliot, “The Wasteland”

করোনা-সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতিতে এই ২০২০ সালে এলিয়টের কবিতায় বর্ণিত 'নিষ্ঠুর এপ্রিল' মাসের কথা আবার আলোচিত হচ্ছে। কবির কল্পনা ও কাব্যিক চিত্রকল্প বাস্তবের প্রেক্ষাপটে শতবর্ষ পরে দেখতে পাওয়ার কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। তবু বাস্তবে তেমনি হলো ২০২০ সালে এই এপ্রিল মাসে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে চীনে উবেই প্রদেশের উহানে উদ্ভূত নতুন ও প্রাণঘাতী, ভয়ঙ্কর করোনাভাইরাস এপ্রিল মাসের শেষে পাঁচ মাসের বয়সসীমায় আরো সক্রিয় হয়ে  বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। তখন এলিয়টের কবিতার লাইনে উচ্চারিত ভয়ের ও নিষ্ঠুরতার এপ্রিলের কথা মনে পড়ে। আর তখনই একটি আশাবাদী উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯-২২ অক্টোবর ১৯৫৪)  কবিতা। অথচ সাধারণভাবে জীবনানন্দকে বিষণ্ণতার কবি, 'ঝরা পালক' ও 'ধূসর পৃথিবী'র বেদনামগ্ন কবি বলেই সবাই জানেন।

জীবনানন্দের ভাষায়: 'আমাদের দেখা হোক মহামারি শেষে/আমাদের দেখা হোক জিতে ফিরে এসে/আমাদের দেখা হোক জীবাণু ঘুমালে/আমাদের দেখা হোক সবুজ সকালে/আমাদের দেখা হোক কান্নার ওপারে/আমাদের দেখা হোক সুখের সকালে।'

জীবনানন্দ ছিলেন এলিয়টের চেয়ে ১০ বছরের কনিষ্ঠ। কিন্তু তিনি মারা যান এলিয়টের ১০ বছর আগে। জীবনকালের হিসেবে জীবনানন্দ বেঁচে ছিলেন এলিয়টের চেয়ে কম সময়। তবু তারা ছিলেন সমসাময়িক। দেখেছেন গত শতাব্দীর বিশ শতকের মহাযুদ্ধ, মন্দা, দুর্ভিক্ষ, ডিপ্রেশন। ফলে তাদের কবিতায় সে ছবি এসেছে, যদিও তা ভিন্ন আঙিকে।

এলিয়ট ও জীবনানন্দের সময়কাল একই হলেও দুজনের পটভূমি ভিন্ন। একজন পাশ্চাত্যের জলবায়ু ও পরিবেশের সন্তান। আরেকজন প্রাচ্যের জাতক। কিন্তু এপ্রিল, উভয়ের জন্যই এবং উভয়েই জীবনেই বসন্তের সমার্থক। আমাদের প্রাচ্য দেশে পলাশ, শিমূলে বসন্ত যেভাবে আসে মার্চ ও এপ্রিলে, পাশ্চাত্যের এপ্রিলে আসে শীত শেষের সবুজ বসন্ত।

পাশ্চাত্যের শীতার্ত ভূগোলে বসন্ত এলে দিন প্রলম্বিত ও আলোকিত হয়। তাপমাত্রা বাড়ে। মনোরম রৌদ্রজ্জ্বল নীল আকাশ জানান দেয়, শীত শেষ এবং বসন্ত এসে গিয়েছে সবুজের সমারোহে। প্রাচ্যেও ঝরাপাতার দিন শেষে কাছাকাছি সময়ে আসে বসন্ত।

কিন্তু, এবছরে, ২০২০ সালে, পৃথিবীর উভয় গোলার্ধেই বসন্ত মহামারির সম্মুখীন। প্রকৃতি জাগলেও মানুষ সামাজিক দূরত্ব পালনের জন্য সঙ্গরোধে ঘরবন্দী। মানুষ ও উৎসবের সঙ্গে সম্পর্কহীনতার জন্য এবার বসন্ত অবরুদ্ধ, নিস্তব্ধ, নিঃসঙ্গ।

বাংলাদেশে অভাবনীয় নৈঃশব্দের বসন্ত আমরা দেখেছি। পশ্চিমের ছবিও তেমনই। প্রকৃতিবান্ধব,  নদীর তীরের, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আকাশচুম্বী অট্টালিকাময় পাশ্চাত্যের  নগরীগুলোও এই প্রাণবন্ত বসন্তে জনমানবশূন্য, ভুতুড়ে। জীবনও প্রকৃতির মতোই নিঃশব্দে বয়ে চলেছে সেখানে।

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়া পাশ্চাত্যের অধিকাংশ শহর পুনর্গঠনের পর, তা এখন নানা দামি ওয়াইন আর মূল্যবান ইতিহাসে ঠাসা। কয়েক শতাব্দী পুরনো ইউনিভার্সিটি, গবেষণা, সভ্যতারচর্চার সূত্রে শহরগুলোর বাসিন্দারা পোড় খাওয়া ও ঘাত সহনীয়। কিন্তু তারাও করোনা-প্রকোপের জেরে এবং কড়া নিয়মকানুনের ফলে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতার অধিবাসী।

ঝলমলে জনপদগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং এরই মধ্যে চলছে রোগ ও মহামারির বিরুদ্ধে জীবন বাঁচানোর লড়াই। সুপারমার্কেট, ওষুধের দোকান বা কাজের জায়গা এখনও পর্যন্ত খোলা রয়েছে। মার্কেটের ভেতরে লাল দাগ দিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। শরীরচর্চা বা মুক্ত বাতাসের জন্য বাইরে বেরনোতে নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও দুইয়ের অধিক জমায়েতে জরিমানাও রয়েছে।

আগে মানুষ, ট্রেনে, বাসে যাতায়াত করলেও এখন পাহাড়ি বা প্রাকৃতিক চড়াই-উতরাই পথে সাইকেলই ভরসা। প্রত্যেক বাসই প্রায় যাত্রিহীন, এমনকি টিকিট চেক করার ব্যবস্থাও এখন বন্ধ। সবাই এই বসন্তে এক ভীতিকর, দমবন্ধ পরিবেশের কাছে সম্পূর্ণভাবে জিম্মি। মানুষের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে চরম ভীতি ও সন্ত্রস্ততায়। সারাক্ষণ এক রকম টাচ-ফোবিয়া বা সংস্পর্শ-ভীতি কাজ করেছে। দরজার হ্যান্ডেল, কফি মেশিন, চায়ের কাপ, ল্যাবের যন্ত্রপাতি হোক বা কম্পিউটার, যে কোনও কিছুই ছুঁয়ে দেখতে ভয় পাচ্ছে মানুষ।

এরচেয়ে কঠিনতম জীবন আর হতে পারেনা। এরচেয়ে নিষ্ঠুরতার এপ্রিল হতে পারেনা। এলিয়টের কল্পনার চেয়েও যা ভয়ঙ্কর। তথাপি মানুষ মব্জাগতভাবে আত্মবিশ্বাসী। নাগরিক সচেতনতা, মজবুত অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ও  উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে উন্নত পাশ্চাত্য দেশের মানুষ মারণ ভাইরাস প্রতিহত করতে অবিরাম প্রচেষ্টারত।

কিন্তু ঠিক উল্টো চিত্র আমাদের প্রাচ্য জনপদে। নাগরিক সচেতনতা নেই, চিকিৎসা পরিকাঠামোর অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা অপর্যাপ্ত। অথচ সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি, নাগরিক সচেতনতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া এই বিপদ থেকে উত্তরণের অন্য কোনও পথই নেই আপাতত।

বিশ্বব্যাপীই করোনার বিরুদ্ধে চলমান  এই লড়াই ব্যক্তিগত নয়, আঞ্চলিক নয়, এ লড়াই সমষ্টির ও বৈশ্বিক । মানুষকে যাবতীয় মতান্তর ও বিভেদ পাশে সরিয়ে যূথবদ্ধতায় একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করার সময় এখন। এই ঐক্যবদ্ধ লড়াই যত বিলম্বিত হবে, তত বিপদ বাড়বে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইটা করতে হবে ঘরে বসেও। করতে হবে, অভুক্তদের অন্নসংস্থান করে বা সকলকে পরিচ্ছন্নতার পাঠ দিয়ে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য একাকার এই মানুষ বনাম রোগের যুদ্ধে।

হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতাস্থল আমাদের পৃথিবী বহু ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে আজও টিকে আছে। মানুষের একমাত্র বসবাসস্থল পৃথিবীকে নীরোগভাবে বাঁচিয়ে রেখে বাঁচাতে হবে মানব সম্প্রদায়কে। করোনার এই প্রতিকূল অন্ধকারময় দিনগুলো পেরিয়ে আনতে হবে জীবনের অনিন্দ্য রঙে আলোকিত জীবন। করোনা ত্রাসিত কিংবা  এলিয়টের 'নিষ্ঠুরতম এপ্রিল' মাসের আতঙ্ক পেরিয়ে পৌঁছুতে হবে জীবনানন্দের আশাবাদে: আমাদের আবার দেখা হবে 'সুখের শহরে', 'সবুজ সকালে'।  

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;