মাঝামাঝি থেকে দেখা মোহাম্মদ নাসিম



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দিনটা ২০১৬ সালের ২৪ মার্চ। আগের রাতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার টেন থেকে ভারতের কাছে এক রানে হেরে বিদায় নিয়েছে বাংলাদেশ। খুব ভোরে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে রওনা করি আমরা। তৎকালীন সময়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা পরীক্ষিৎ চৌধুরীর সঙ্গে বাসে আমরা বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। বাসে সকলের মুখেই গত রাতে ক্রিকেটে পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ আর আক্ষেপ। আমরা যাচ্ছি টাঙ্গাইলে। কালিহাতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শেখ হাসিনা হেলথ কার্ড কর্মসূচীর উদ্বোধন করবেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সেই নিউজই কাভার করতে যাচ্ছি আমরা।

গাজীপুর পার হয়ে একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তার জন্য গাড়ি থামানো হলো। মন্ত্রীর গাড়িও এখানে থেমেছে। বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল। দ্রুত নাস্তার টেবিলে বসে পড়লাম। গরুর পায়ার সঙ্গে  তন্দুর রুটি নিলাম আমি। তবে বিধি বাম! হাত থেকে মাংসের হাঁড় ফসকে পড়লো ঝোলে আর শার্টে ছিটকে আসলো। সাদা শার্টের অবস্থা হলো বেমানান। দ্রুত বেসিনে যেয়ে সাবান দিয়ে যতটুকু পারা যায় গায়ের শার্ট ধোয়ার চেষ্টা করলাম। এরপরও কি দাগ যায়!

নাস্তার পর্ব শেষে আবারো রওনা দেয়ার পালা। আমাদের সাংবাদিকদের কাছে আসলেন মোহাম্মদ নাসিম। জিজ্ঞাসা করলেন, 'কি নাস্তা করা হয়েছে ঠিকমতো?' উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমার শার্টের দিকে চোখ গেলো মন্ত্রীর। বললেন, 'বোঝাই যাচ্ছে নাস্তা হয়েছে, তুমিতো দেখি শার্টকেও খাইয়েছো!'

সংবাদ সংগ্রহ করতে যেয়েই তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে আমার যতটুকু দেখা। উনার সঙ্গে খুব বেশি ব্যক্তিগত সর্ম্পক ছিল না, যতটুকু শুধু দেখেছি আর মন্ত্রী হবার পরপর একটি সাক্ষাৎকার নিতে যেয়েই যতটুকু আলাপ। এর বাইরে বলতে গেলে মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা বা কোন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা শেষে বের হওয়ার সময় সংবাদ নিয়েই দুই চারটি কথা। তাই কাছ থেকে বা দূর থেকে দেখা নয়, মাঝামাঝি দেখা থেকে মোহাম্মদ নাসিম সর্ম্পকে এই লেখা। সমালোচনার বাইরেও জাতীয় চার নেতার একজন এম মনসুর আলীর সন্তান প্রবীণ এই রাজনীতিবিদের আন্তরিকতা আর মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বরাবরই আকর্ষণ করতো।

২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ নাসিম যখন দায়িত্ব নেন, তখন একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল যে তিনি শুধু স্বাস্থ্য নিয়ে নয় বরং বক্তৃতায় রাজনীতির কথা থাকবে অনেক। বক্তৃতায় হাস্যরস করতে পারতেন যথেষ্ট। মঞ্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দীন মোহাম্মদ নুরুল হককে উদ্দেশ্য করে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমার চোখের ডাক্তারের যেই অবস্থা, ভাল করে চোখে দেখি না! তেমনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও কি একই হাল!’ আবার পরক্ষণেই বলতেন, ‘নুরুল হক দেশের সেরা চক্ষু চিকিৎসক।’ বক্তৃতায় দরাজ গলায় স্বরের ওঠানামা করিয়ে সকলের মনোযোগ কেড়ে নিতেন তিনি। সাংবাদিকদের জন্য কোনটি সংবাদ হবে, সেটি খুব ভাল বুঝতে পারতেন।

২০০৯ সাল থেকে যতবার মোহাম্মদ নাসিমের অনুষ্ঠান কাভার করেছি, সবগুলোতেই তাকে দেখেছিলাম,  আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের মুখপাত্র হিসেবে। তবে ২০১৪ সালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর অনেক বেশি সংবাদ কাভার করার সুযোগ হয়। একটা কথা প্রচলিত ছিল মোহাম্মদ নাসিমের ক্ষেত্রে। সেটি হচ্ছে, তিনি কোন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতেন না। তবে সবখানেই দেরিতে পৌঁছাতেন।

২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবারের মতো কোন হাসপাতাল পরিদর্শনে যাবেন তিনি। খবরটি শুনে আমিও দ্রুত চলে গেলাম জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান, নিটোরে।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন ডা. আফম রুহুল হক। তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা মোহাম্মদ নাসিম। পঙ্গু হাসপাতালের শয্যায় থাকা এক নির্মাণ শ্রমিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নাসিম। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলেন, ‘আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।’ এরপর খুব কৌশলে শ্রমিকের হাতের মুঠোয় গুঁজে দিলেন কিছু টাকা। এরপর লিফটের পথে হাঁটা দিলেন মন্ত্রী, পেছনে আবারো প্রায় অর্ধশত মানুষ।

এই ছিলেন রাজনীতিবিদ নাসিম। হাসপাতালে তার পদচারণায় যেমন রোগীদের মধ্যে ভাল লাগা ছিল, সমস্যাও তৈরি হচ্ছিল কিছুটা। সাময়িকভাবে হাসপাতালের পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছিল।

তবে শ্রমিকের বেদনার মুখে যে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা মনে হয় অনেক নামী-দক্ষ চিকিৎসকের পক্ষেও উপহার দেয়া সম্ভব হবে না। দেশের একজন মন্ত্রী এতো সন্তর্পনে হাতে টাকা গুঁজে দিলেন, যেন গোপনে একজন আত্মীয় আরেকজনকে সাহায্য করছেন।

এদিন হাসপাতালে মন্ত্রীর সঙ্গে এসেছিলেন, বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল। তবে মিডিয়া এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের মূল আকর্ষণ ছিলেন নাসিমই।

চলনে-বলনে বেশ গম্ভীর ছিলেন এর আগের স্বাস্থ্যমন্ত্রী  দেশ সেরা সার্জন ডা. রুহুল হক। নাসিমের বহরে রাজনৈতিক নেতাদের প্রাধান্য যেমন থাকতো, তেমনি রুহুল হকের বহরে থাকতো চিকিৎসক নেতাদের হাতঘষা।

রাজনীতিবিদ মন্ত্রী এবং পেশাজীবী মন্ত্রীর মধ্যে একটা স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করেছিলাম। এর আগে ২০১৩ এর অক্টোবরের ১৩ তারিখে হরতালে পিকেটারদের ছোড়া বোমায় চোখের কর্নিয়া হারানো রহিমাকে দেখতে চক্ষু হাসপাতালে যান তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হক। তাঁকে দেখতে গিয়ে সব ধরণের চিকিৎসা সহযোগিতার আশ্বাস দেন। সেদিন মন্ত্রী সব মিলিয়ে ২ মিনিটের বেশি কথা বলেননি পোষাকে মলিন রহিমার বাবা-মায়ের সঙ্গে। চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ে পরিচালকের রুমে প্রবেশ করেন তিনি। চিকিৎসক নেতাদের আবদ্ধ হন তিনি। আবার পঙ্গু হাসপাতালে রোগীদের অস্ত্রোপচার হওয়া স্থান নিজ হাত দিয়ে ধরে বেশ মনোযোগী হয়েই পরীক্ষা করতে দেখা গিয়েছিল রুহুল হককে। কারণ তিনি চিকিৎসক হিসেবে বুঝতেন সেটি।

অন্যদিকে চিকিৎসাবিদ্যা সর্ম্পকে মোটেও ধারণা ছিল না নাসিমের। নিজেই ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, আমি এ সেক্টর সর্ম্পকে কিছুই বুঝি না। আমার পরিবারে একজনও ডাক্তার নেই। বিশেষ কিছুই জানি না। তারপরও প্রধানমন্ত্রীর দেয়া দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

রুহুল হক পাঞ্জাবিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। স্যুটেড হয়ে থাকতেন তিনি। গরমে প্রিন্টের শার্ট গায়ে দিতেন। হাসপাতালে পরিদর্শনে রোগীদের সঙ্গে কথা হতো কম। চিকিৎসক, শিক্ষক আর পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলেই সারতেন পরিদর্শন।

তুখোড় রাজনীতিবিদ নাসিম পাঞ্জাবি আর হাতা কাটা কোটেই অভ্যস্ত ছিলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে পোশাক অনুসরণ করেন তারা।

বক্তব্যের সময় উচ্চারণে স্পষ্ট ছিলেন নাসিম। বক্তব্যে থাকতো রাজনীতির কথা। বিরোধীদলে প্রতি সতর্কবাণী। দলীয় নেতা কর্মীদের প্রতি দিক নির্দেশনা দেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেও বক্তব্যে প্রফেশনাল টার্ম ছিল কম। সোজাসাপ্টা কথা বলতেন।

স্বাস্থ্য বিষয়ক অনুষ্ঠানেও রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে আনতেন নাসিম। তিনি নিজেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে নিজেই সাংবাদিকদের জরুরি বিষয়গুলো অবগত করতেন। সেখানে অন্য কারো স্থান ছিল না। অন্যদিকে রুহুল হক কিন্তু রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে একেবারেই পারদর্শী ছিলেন না। মন্ত্রীকে পেছনে ফেলে সেই সময়ে স্বাস্থ্য সেক্টরে বাক পটুতায় পরিচিতি অর্জন করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. মোদাচ্ছের আলী।

বক্তব্যের সময় রুহুল হকের উচ্চারণ নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে ফিসফিস চলতো। বলাবলি হতো, তিনি মন্ত্র আওড়াচ্ছেন বিড়বিড় করে। কারণ অনেক কথাই বোঝা যেত না। বাংলা ইংরেজি মিশ্রণে বক্তব্য দিতেন বেশিরভাগ সময়। আর নাসিমের বক্তব্যে ইংরেজির ব্যবহার ছিল না বললেই চলে।

করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়ে কাছের অনেককেই একটা কথা বলেছিলাম। মোহাম্মদ নাসিম আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকলে হয়তো এই দুরাবস্থায় আমরা পড়তাম না। কারণ উনার রাজনৈতিক স্বর ছিল অনেক শক্তিশালী। সেখানে আমলা বা অন্যরা তাকে এড়িয়ে যেয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়াটা এতোটা সহজ হতো না!

আরো পড়ুন: সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আর নেই

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;