জিন্নাহ: এখনো বিতর্কিত, রহস্যময় রাজনৈতিক চরিত্র!
কোনও ইসলামি আচার না-মানা একজন মানুষ হলেন ইসলামি রাষ্ট্রের জাতির পিতা! ইসলামের অনুগামীরা অনুসারী হলেন এই ধর্ম-না-পালনকারী লোকটির। জাদুকরের মতো ভোলবাজিতে তিনি ইসলাম ও মুসলমানের কাণ্ডারী হলেন, আদৌ কোনো ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিধিমালা না মেনেই। ধর্ম মানেন না, অথচ তিনিই আশ্চর্যজনকভাবে সফল হলেন ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন’রূপে! এতো বছর পরে এখনো উপমহাদেশের এক বিতর্কিত ও রহস্যময় রাজনৈতিক চরিত্র মুহম্মদ আলী জিন্নাহ।
যদিও সরোজিনী নাইডু একদা তাকে বলেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের ‘সম্প্রীতির দূত।’ এমন একজন মানুষ কী করে এবং কেনই বা ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক-জাতিভিত্তিক রাজনীতির নেতৃত্ব দিলেন? এসব তাঁর ভেতরের টান নাকি রাজনৈতিক যোগ-বিয়োগের বাস্তবতা? কোন্ রাজনৈতিক ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ায় এবং কোন্ মতাদর্শিক ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের ‘সম্প্রীতির দূত’ পরিণত হলেন ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন’-এ? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি।
ইতিহাসবিদগণ এই অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছেন আর রাজনীতি-বিজ্ঞানের গবেষকগণ এর অন্তর্নিহিত কারণ বিশ্লেষণ করছেন।
তবু অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই এ যাবত প্রকাশিত হেক্টর বোলিথো, স্ট্যানলি ওলপার্ট, আয়াশা জালাল, যশবন্ত সিংহ প্রমুখের গবেষণা গ্রন্থে।
সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছে ইয়াসের লতিফ হামদানির ‘জিন্নাহ: আ লাইফ’ গ্রন্থটি। হামদানি প্রথাগত ইতিহাসবিদ নন, তিনি পাকিস্তানের সুপরিচিত আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী। পাকিস্তানে ইউটিউবের ওপর থেকে রাষ্ট্র আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তোলার মামলায় তাঁর জয় তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল।
জিন্নাহকে নিয়ে এটি হামাদানির দ্বিতীয় গ্রন্থ। প্রথম বই ‘জিন্না: মিথ অ্যান্ড রিয়্যালিটি’, প্রকাশ পায় ২০১২ সালে। তিনি নতুন কিছু তথ্য দিলেও জিন্নাহকে ঘিরে আবর্তিত বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
তবে, ২৫ ডিসেম্বর ১৮৭৬ সালে জন্মগ্রহণকারী জিন্নাহর রহস্যজাল উন্মোচন করা আসলেই কঠিন। তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় জাতীয় কংগ্রেসে। ১৯০৬ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী এক কংগ্রেসি রাজনীতিবিদ।
পরের সময়কালে তিনি যোগ দেন মুসলিম লীগে। যোগ দেন বলা ভুল। বরং ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগকে উত্তর ভারতের উর্দুভাষী লোকদের নিয়ে পুরোপরি দখল করে পকেটে ভরে ফেলেন তাঁর সমকালের এই জাঁদরেল আইনজীবী। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পুরো উপমহাদেশে সৃষ্টি করেন প্রবল উত্তেজনা। মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধের রাজনীতিতে পাকিস্তান সৃষ্টি করলেও ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে ৭১ বছরে মারা যাওয়ায় তিনি ক্ষমতার স্বাদ পান সামান্যই।
তথাপি ‘কায়েদ-ই-আযম’ বা জাতির পিতারূপে তিনি অধিষ্ঠিত পাকিস্তানে। আর এই লোকটির ছবিই প্রায়-জোর করে চব্বিশ বছর বাঙালিদের মাথায় চেপে বসেছিল আর তিনিই উর্দুভাষীদের পক্ষে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আগ্রাসনের রাষ্ট্রীয় উস্কানিদাতা প্রথম ব্যক্তি, যার দেখানে পথেই চলেছিল পূর্বের বিরুদ্ধে পশ্চিমের আভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ-নির্যাতন।
বিগত কয়েক দশক এহেন জিন্নাহকে ঘিরে উপমহাদেশের রাজনীতিতে লুক্কায়িত বহু ধাঁধা ভেদ করার চেষ্টা করে এসেছেন বহুজন। অধিকাংশই ইংরেজিতে। বাঙালির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সত্ত্বাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী এহেন জিন্নাকে নিয়ে বিশ্লেষণ-মূল্যায়ন বাংলা ভাষায় নেই বললেই চলে। ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার নিরিখের মতো জিন্নাকে বাঙালির ডাইমেনশনে ও বাঙালির পার্সপেক্টিভ থেকে অবলোকনের অবকাশ আছে।
বিশেষত, পশ্চিম ও উত্তর সব সময়ই পূর্ব প্রান্তের বাঙালি জাতিসত্তার তীব্র বিরোধী, জিন্নাহকে সামনে রেখে এই ঐতিহাসিক সত্যটি অন্ততপক্ষে উন্মোচন করা আবশ্যক। জিন্নাহর মতোই তাঁর নিকটবর্তীরা এখনো আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতির নামে ক্ষতি, উস্কানী ও আগ্রাসনের হীন পথ অবলম্বন করছেন। ধর্মীয়, জাতিগত, আঞ্চলিক বা ভাষাগত সাম্প্রদায়িক উন্নাসিকতায় ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের আবডালে ক্ষতি করছেন গণতন্ত্রের, ধর্মনিরপেক্ষতার, অসাম্প্রদায়িকতার, মানবিক মূল্যবোধের।
জিন্নাহ শুধু একজন ব্যক্তি জিন্নাহ নন, এখনো একজন বিতর্কিত, রহস্যময় রাজনৈতিক চরিত্র, যিনি দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরম্পরাগত আইকন। যার দেখানো ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার মন্ত্রে উজ্জীবিত আরো অনেকেই মানুষের রক্ত ও অধিকার নিয়ে বর্তমানেও উগ্র-ষড়যন্ত্রের বিভেদমূলক রাজনৈতিক খেলা খেলছে উপমহাদেশের সর্বত্র।