মেয়েরা না ঘুমানো পর্যন্ত তাদের মা ‘মাস্ক পরে’ দরজায় বসে থাকত
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসমহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ'র প্রতি অশেষ শুকরিয়া ২৭/২৮ দিন আইসোলেশনে থাকার পর আমরা ৪ ও ৫ জুলাই সস্ত্রীক করোনার নেগেটিভ রিপোর্ট পেয়েছি।
গত ৭ জুন ২০২০ আমরা সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হই। দু'জনেই একত্রে আক্রান্ত হওয়ায় সংগত কারণেই প্রথমে আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কেননা বাসায় আমরা দু'জন ছাড়াও আমাদের আদরের পুণ্য ও পদ্য রয়েছে। মেয়েদের করোনা টেস্ট করালে আল্লাহর রহমতে নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মেয়ে দু'জনকে ময়মনসিংহে তাঁর খালামনি বা নানুর বাসায় পাঠিয়ে দেব। কিন্তু মেয়ে দু'জন কোন ক্রমেই তাঁর মা'কে ছাড়া অন্য কোথাও যেতে রাজি হয়নি, তাদের মা সাফ জানিয়ে দেয় মেয়েদের না দেখে থাকতে পারবে না। যদিও আমার স্ত্রীকে সিএমএইচের ডাক্তার সেখানে ভর্তি হতে বলেন, কিন্তু মেয়েদের না দেখে থাকতে হবে এ চিন্তা করে ভর্তি হয়নি। এছাড়া খালামনি বা নানুদের মাঝে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ভয়ে তাদের কাছে না পাঠিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে আমাদের বাসায় আলাদা আলাদা রুমে আইসোলেশনে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
আমাদের যে ছোট্ট মেয়েরা বিশেষ করে ছোট পদ্য মামনি মায়ের স্পর্শ ছাড়া এক রাতও ঘুমাতে পারে না সে আলাদা রুমে তাঁর বড় বোন যাকে আপিয়া বলে ডাকে তাঁর সাথে ঘুমানো শুরু করলো। কিন্তু প্রথম দিন সারা রাত তাদের ঘুম আসেনি। ঘুম আসেনি তাদের মা'রও। যখন আমি আমার রুম থেকে দেখলাম আমার ছোট্ট মেয়ে মধ্য রাতে না ঘুমিয়ে তাঁর মায়ের কক্ষের দরজার পর্দায় ধরে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঘরের ভিতর না ঢুকে দেখছে তাঁর আম্মু কি করছ, এ দৃশ্য দেখে আমি আর চোখের জল সামলাতে পারিনি। সামনে এগিয়ে দেখি বড় মেয়েও না ঘুমিয়ে চোখে ভরা জল নিয়ে তাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে তাদের মা বালিশে চোখ লুকিয়ে হু হু করে কাঁদছে। মধ্যরাতে কি যে এক কষ্ট- নীরব নিস্তব্ধ বাসায় চারজনের চোখের জলে বিষাদময় পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। অন্য কেউ যদি সে দৃশ্য দেখতে পেতো তারও চোখের জল সংবরণ করা সম্ভব হতো না। এরপর থেকে প্রায়ই প্রতিটি রাতে মেয়ে দু'টি না ঘুমানোর পর্যন্ত তাদের মা'কে তাদের রুমের দরজার সামনে মাস্ক পড়ে বসে থাকতে হতো।
মেয়েদের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য যা যা করণীয় সাধ্যমত সব করার চেষ্টা করেছি। বাসাটিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছি। পানির গ্লাস থেকে শুরু করে তাদের সব কিছু আলাদা করে দিয়েছি। প্রথম দিকের একরাতের ঘটনা, হঠাৎ শেষ রাতে ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই, কে যেন উহ উহ করে কাঁদছে। আমার মনে হলো মেয়েদের ঘর থেকেই শব্দ আসছে। আমি দৌঁড়ে গিয়ে তাদের রুমের দিকে উঁকি দিলাম। যা দেখলাম তা দেখে মুহূর্তে চোখে জল এসে গেল। আদরের ছোট মামনি পদ্য উজুগুজু হয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে, তার বড় আপিয়ার দিকে বার বার তাকিয়ে দেখছে আপিয়া তার কাতরানো শুনছে কিনা। আমি তখন কি করবো বুঝতে পারছিলাম না, শুধু এটুকুই ভাবলাম যে ভাবেই হউক মেয়েদের রক্ষা করতে হবে। আমি ২টি সার্জিক্যাল মাস্ক পড়ে তার উপর কাপড়ের মাস্ক পড়ে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধূয়ে তাদের রুমে প্রবেশ করে পদ্য'র কপাল, শরীরে হাত দিয়ে দেখলাম মেয়ে আমার প্রচন্ড জ্বরে কাঁপছে- সাথে সাথে আমি একটি পাতলা কাঁথা তার শরীরে দিতেই সে আরামে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। বিষয়টি পাশের রুমে সবেমাত্র গিয়ে শুয়ে থাকা তাদের আম্মাকে জানাতেই সে দ্রুত উঠে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে মাস্ক পড়ে থার্মোমিটারে মেয়ের জ্বর পরিমাপ করে মেয়েকে উঠিয়ে বিস্কুট দুধ খেতে দিয়ে বাসায় থাকা নাপা সিরাপ খাওয়ায় ঘুম পড়িয়ে দেয়। পরদিন সকালে মেয়ের ডাক্তার মামা ও বন্ধু ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে বাসায় জিমেক্স সিরাপ আনিয়ে রাখি। কিন্তু পরে আল্লাহর রহমতে মেয়ের আর জ্বর না আসায় ওষুধ খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়েনি।
এবার আসি আমার প্রসঙ্গে, ৭ জুনের কয়েকদিন পূর্বে থেকেই গলায় হাল্কা কফ ও কাশি অনুভব করছিলাম। বার বার গলা পরিষ্কার করতে হতো । সে দিনগুলোতে আমার মিসেসের হাল্কা জ্বর থাকলেও আমার কোন জ্বর ছিল না। আমি ৭ জুন বিকেলে হাল্কা জ্বর জ্বর অনুভব করলাম, তাপমাত্রা ৯৯ থেকে ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট । বাসায় থাকা নরমাল নাপা খেয়ে সেদিন সন্ধ্যা রাতেই আলাদা রুমে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কাশি ও জ্বরের জন্য সারারাত ঘুমাত পারিনি। তেমন শ্বাস-কষ্ট না থাকলেও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। ডাক্তার বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করলাম, তাদের মধ্যে বাল্যবন্ধু শেরপুর জেলা হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আলগীর মোস্তাক আহমেদ শাকিল ( আমি আক্রান্ত হওয়ার কিছুদিন পূর্বে যে করোনা পজিটিভ থেকে নেগেটিভ হয়) কিছু ওষুধ পরামর্শ লিখে প্রেসক্রিপশন আমার মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেয়। রাত গভীর থাকায় সে রাতে আর ওষুধ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। আমি সেই রাতেই প্রেসক্রিপশনটি আমার পাশের পাড়ায় থাকা কৃষিবিদ বন্ধু শফিউল আলম দিদারের কাছে পাঠাই। তবে রাতে কিছুক্ষণ পর পর প্রায় সারারাতই মশলা মিশ্রিত গরম পানির ভাপ এবং লেবুরস মিশ্রিত হাল্কা গরম পানি পান আমাকে স্বস্তি দিয়েছিল।
পরের দিন সকালে বন্ধু Didar Alam সকাল বেলায়ই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী Ivera 6mg, Zimax 500, Fenedine, Monas 10, সিভিট, ভিটামিন ডি-৩, জিংক টেবলেট, লেবু, নাপা এক্সট্রা দিয়ে যায়। করোনাকালে বিপদের সময় যখন আমার দ্বারা ঘর থেকে বের হওয়া অসম্ভব ছিল সে মুহূর্তে স্বতস্ফুর্তভাবে দিদারের এ সহযোগিতা আমার মনোবল বাড়িয়ে দেয়। দিদারের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
২য় দিন সকালে খালি পেটে ২টি আইভেরা, ভরা পেটে ১টি ফেনাডিন ও ১টি নাপা এক্সট্রা খেয়ে ফেলি। রাতে ভরা পেটে ২টি জিমেক্স ১টি ফেনাডিন, ১টি নাপা এক্সট্রা, ১টি মোনাস খাই। এভাবে আমি ৭ দিন রাতে ১টি করে জিমেক্স খাই। কয়েকদিন পর জ্বর কমে গেলে নাপা খাওয়া বন্ধ করে দিই। ২দিন পর আবার খালি পেটে ২টি আইভেরা খাই। তবে রাতে মোনাস খাওয়া চলতে থাকে যা এখনও চলছে। কিছুদিন ভিটামিন ডি-৩, জিংক খাই। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪ বার মশলা মিশ্রিত গরম পান
পরে মনোবল আরো চাঙা রেখে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ৩০ জুন শাহবাগস্থ পুরাতন বেতার ভবনে বিএসএমএমইউ ফিভার ক্লিনিকে কৃষিবিদ কোঠায় আবার শুধু আমার নমুনা দেই। কিন্তু সেখানে মোবাইল এন্ট্রির জটিলতার কারণে ফলাফল পেতে দেরী হওয়ায় ৪ জুলাই ১০:৩০ মিনিটের দিকে ২ জনই আবার সিএমএইচে নমুনা দেই। সেদিন দুপুরের দিকে বিএসএমএমইউ এর ডাক্তার বন্ধু ওয়ালিউর সুমনের মাধ্যমে জানতে পারলাম আমার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ। পরের দিন ৫ জুন সিএমএইচের রিপোর্টও নেগেটিভ আসে। আলহামদুলিল্লাহ ।
আমাদের সকল সহকর্মী, দেশে- বিদেশে আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন যেভাবে আমাদের সাহস দিয়েছেন, দোয়া করেছেন তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ। আপনাদের এত ভালবাসার আমরা যোগ্য নই। আমরা সত্যিই অভিভূত। আপনাদের এই দোয়ার বরকতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে রহম করেছেন।
সবাইকে অনুরোধ করব আপনারা স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন, বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করুন। কেউ করোনা আক্রান্ত হলে আতংকিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাসায় আইসোলেশনে থেকে পরামর্শ মেনে চলুন।
লেখক: মো. নাজমুল হুদা, বাংলাদেশ বেতারের উপ পরিচালক