অকস্মাৎ মুখোমুখি সৌদি-তুরস্ক
নাটকীয় মেরুকরণে অকস্মাৎ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ দুই দেশ সৌদি আরব ও তুরস্ক। তুরস্কের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে 'অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা' আরোপ করেছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রভাবশালী দেশের মুখোমুখি অবস্থানের ফলে পুরো অঞ্চলে নতুন করে উত্তেজনার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে সৌদি-তুর্কি সংঘাত নতুন নয়। মূলত তুর্কি উসমানিয়া সালতানাতের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সমর্থনে বিদ্রোহ করেই সৃষ্টি হয়েছে সৌদি আরব নামের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফলে দেশ দুটি সুন্নি ভাবাপন্ন মুসলিম দেশ হলেও রাজনৈতিক সংঘাতের প্রাচীন ইতিহাস বহন করছে।
সাম্প্রতিক সময়েও মধ্যপ্রাচ্যে যে আভ্যন্তরীণ মতাদর্শিক সঙ্কট সুপ্তভাবে চলছে, তাতেও তিনটি দেশ জড়িত। একদিকে ইরানের নেতৃত্বে শিয়া ইসলামের অনুসারী দেশ ও সরকারগুলো, অন্যদিকে সালাফি ইসলামপন্থী সৌদি আরব আর তৃতীয়ত কট্টর সুন্নিপন্থী তুরস্ক নিজেদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভূ-কৌশলগত প্রাধান্য বিস্তারে তৎপর।
দৃশ্যত মধ্যপ্রাচ্যে লড়াইটি সৌদি-ইরান সমীকরণে চললেও শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সঙ্কট একটি ত্রিভূজে পরিণত হয়েছে, যার তিনটি কোণে অবস্থান করছে ইরান, সৌদি আরব ও তুরস্ক। সৌদি আরব কৌশলগত কারণে ইরানের বিরুদ্ধে যে স্নায়ুযুদ্ধে চালাচ্ছে, তাতে এখন যুক্ত হয়েছে তুরস্কও। যদিও সিরিয়া এবং ককেশাসের আজারবাইজান-আর্মেনিয়া ইস্যুতে তুরস্ক ও ইরান আগে থেকেই বৈরীভাবাপন্ন।
ফলে কেউ কারো বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার অবস্থানে নেই। তিন পক্ষই পারস্পরিক লড়াইয়ের জায়গায় চলে এসেছে। মতাদর্শ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে এখন প্রতিটি দেশকেই বাকি দুইটি দেশের সঙ্গে সংঘাতময় অবস্থানে রয়েছে।
ইরান ও সৌদি বৈরিতা সামরিক দিকে প্রসারিত হলেও সৌদি-তুর্কি দ্বন্দ্ব ছিল প্রচ্ছন্ন। কিন্তু এবার তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে স্পর্শ করেছ। বস্তুত তুরস্ককে শায়েস্তা করতে দেশটির বাজার বন্ধের কৌশল হাতে নিয়েছে পশ্চিমা মদদপুষ্ট সৌদি আরব। তবে পশ্চিমা শক্তির উপর নির্ভরশীল সৌদি আরব সামরিক-রাজনৈতিক দিক থেকে মজবুত তুরস্কের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছে সাবধানে ও কৌশলে। সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে সৌদি প্রশাসন তুরস্কের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপের নাম দিয়েছে 'অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা'।
মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি সরকারের প্রভাবেই চলমান তুর্কি পণ্য বয়কটের প্রচারণা চলছে। ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই প্রচারণা। এমনকি, সৌদি সরকারের খাদ্য এবং ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ (এসএফডিএ) তুরস্ক থেকে সব ধরনের মাংস, মাছ, ডিম এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য আমদানি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। তুর্কি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও সৌদি আরবের এই সিদ্ধান্তের কথা নিশ্চিত করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে দেশের রপ্তানি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌদি এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো সমগ্র সৌদি আরবে 'তুর্কি বয়কট' ক্যাম্পেইনের খবর গত কয়েক মাস ধরেই জানিয়ে আসছে। সরকারের ছত্রছায়ায় বিভিন্ন সংস্থা তাদের ভাষায় 'সৌদি নেতৃত্ব, দেশ এবং সৌদি জনগণের বিরুদ্ধে অব্যাহত বৈরি আচরণের' জবাবে তুরস্কের তৈরি সব কিছু বর্জনের জন্য জনগণের প্রতি ডাক দিয়ে চলেছে। কোথাও কোথাও স্লোগান দেওয়া হয়েছে, 'তুরস্কে কোনো বিনিয়োগ নয়, তুরস্ক থেকে কোনো আমদানি নয় এবং তুরস্কে কোনো পর্যটন নয়।'
সৌদি চেম্বার, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও চেইন সুপারমার্কেটগুলো তুর্কি বয়কটের ডাকে সাড়া দিচ্ছে। সৌদি আরবের সবথেকে বড় সুপারমার্কেট আথায়াম ছাড়াও দানিউব, তামিমি এবং পাণ্ডা চেইন শপ বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, তাদের বর্তমান মজুদ শেষ হওয়ার পর তারা তুরস্কে তৈরি কোনো পণ্য বিক্রি করবে না।
এদিকে, সৌদি আরবের দোকানগুলোতে টানানো হচ্ছে বড় হোর্ডিং, যাতে তুরস্কের পণ্য না কিনতে আহবান জানানো হচ্ছে। সেই সাথে গত মাস খানেকের ওপর ধরে চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে 'বয়কট-টার্কিশ প্রডাক্টস' হ্যাশটাগে ব্যাপক প্রচারণা। ফলে একদিকে যেমন দোকানের শেলফ থেকে তুরস্কের পণ্য খালি হয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে অবশিষ্ট পণ্যগুলোর দিকে বহু ক্রেতা হাত বাড়াতে কুণ্ঠা বোধ করছেন।
তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে 'অভ্যন্তরীণ সমস্যা চালান' করছেন এমন অভিযোগ রয়েছে সৌদি ও অন্যান্য আরব দেশগুলোর। ফলে আরব দেশগুলো এখন ইরানের মত তুরস্ককেও মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। তাদের অভিযোগ, তুরস্ক সন্ত্রাসী মিলিশিয়াদের সমর্থন দিচ্ছে, মুসলিম ব্রাদারহুডের মত কট্টোরপন্থী দলকে উস্কানি দিচ্ছে। এতে আরব দেশগুলোর নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ছে। এছাড়া, তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি আরব ও তুরস্কের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, যার সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সৌদি আরোপিত তুরস্কের বিরুদ্ধে 'অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা'য়।