ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় শীর্ষ করোনা আক্রান্ত দেশ ভারত
ব্রাজিলকে ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মহামারি করোনা আক্রান্তের পরিসংখ্যানে দ্বিতীয় শীর্ষ দেশ এখন ভারত। ক্রমবর্ধমান সংক্রমণের তোড়ে সোমবার (১২ এপ্রিল) ভারতের পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে। তার আগে বহুদিন ব্রাজিল ছিল বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ করোনা আক্রান্ত দেশ আর আক্রান্তের নিরিখে প্রথম শীর্ষ দেশ এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে সোমবার (১২ এপ্রিল) অনেকগুলো শীর্ষ আন্তর্জাতিক মিডিয়ার লিড শিরোনাম ছিল 'COVID: India overtakes Brazil as world's second worst-hit country.'
লাতিন আমেরিকা থেকে করোনার ধাবমান বিস্তার ভারতের সঞ্চারিত হওয়ার ঘটনা পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর শত কোটি মানুষের বিপদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলে অবস্থিত ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর চিন্তা আর উদ্বেগও বৃদ্ধি করেছে বহুগুণে।
করোনার নতুন ধরন বা স্টেইন-এর উপর্যুপরি হামলার ধারাবাহিকতায় বিশ্বে করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের পটভূমিতে ক্রমবর্ধিষ্ণু মৃত্যু ও আক্রান্ত বৃদ্ধির নিরিখে ভারতে সৃষ্টি হয়েছে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। সেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের ধাক্কায় পরিস্থিতি ক্রমেই বেসামাল হচ্ছে ভারতে। গত ৬ দিন ধরে টানা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে দৈনিক সংক্রমণ। গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ৯১২ জন। এক দিনে আক্রান্তের নিরিখে যা এখনও অবধি সর্বোচ্চ।
গত বছর থেকে এখনও অবধি ভারতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ কোটি ৩৫ লক্ষ ২৭ হাজার ৭১৭ জন। সংক্রমণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের দৈনিক মৃত্যুও বেড়েছে গত কয়েক দিনে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে মৃত্যু হয়েছে ৯০৪ জনের। গত বছর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের পর ফের এত জনের মৃত্যু হল এক দিনে। ভারতে এখনও পর্যন্ত মোট ১ লক্ষ ৭০ হাজার ১৭৯ জনের প্রাণ কেড়েছে করোনাভাইরাস, যার ফলে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ আক্রান্ত দেশে পরিণত হয়েছে ভারত।
সংক্রমণের বাড়বাড়ন্ত ভারতে সক্রিয় রোগীর সংখ্যাকে এক লাফে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৯৩ হাজার। এই বৃদ্ধির জেরে ভারতে এখন সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ১২ লক্ষ ১ হাজার ৯ জন। করোনার প্রথম পর্বেও এত সংখ্যক সক্রিয় রোগী ছিল না দেশে। পাশাপাশি গত কয়েক দিনে বেড়েছে সংক্রমণ হারও।
ভারতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ফের তৎপর হয়েছে প্রশাসন। মধ্যপ্রদেশে ইতিমধ্যেই সপ্তাহান্তে লকডাউন শুরু হয়েছে। মহারাষ্ট্রেও সপ্তাহান্তে লকডাউনের পাশাপাশি রাত্রিকালীন কার্ফু চলছে। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার কোনও লক্ষণ নেই। ১৪ এপ্রিলের পর সম্পূর্ণ লকডাউন জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে সে রাজ্যের প্রশাসন।
বিপজ্জনক এই পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতে চলছে টিকা উৎসব। ৪৫ বছরের বেশি বয়সি সকলে টিকা পাচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে টিকা নিয়েছেন ২৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৪১৮ জন। এ নিয়ে ভারতে মোট ১০ কোটি ৪৫ লক্ষ ২৮ হাজার ৫৬৫ কোভিড টিকার ডোজ দেওয়া হয়েছে। ভারত টিকাকরণের নিরিখেও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ।
ভারতের নানা আচার-উৎসব এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা ও পণ্ডিচেরি, এই চার রাজ্যে নির্বাচন করোনা পরিস্থিতিকে নাজুক করেছে। কোটি কোটি মানুষ নির্বাচনের প্রচারণা ও ভোটের কারণে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি অগ্রাহ্য করেছে। মানুষের বেপরোয়া চলাচলের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া হয়েছে করোনার ব্যাপক বিস্তার ও সংক্রমণের মাধ্যমে। এমনকি, সমাজের সাধারণ স্তর থেকে সর্বোচ্চ বিচারালয়ের হানা দিয়েছে করোনার থাবা।
ভারতেট শীর্ষ আদালতেও করোনার থাবায় বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের বরাতে জানা গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মী কোভিড পজিটিভ। যার ফলে আপাতত বাড়ি থেকেই শুনানি হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত শনিবারই (১০ এপ্রিল) আদালতের প্রায় ৪৪ জন কর্মী করোনায় আক্রান্ত হন। এরপরই অন্যান্য কর্মীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দেয়। আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সকলে। আদালতের কাজকর্ম নিয়েও সমস্যা দেখা দেয়। ফলে বাড়িতে বসেই ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিচারপতিরা।
ইতিমধ্যেই আদালত চত্বর-সহ প্রায় সবকটি ঘরই স্যানিটাইজ করা হচ্ছে। সূত্রের খবর, এবার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরে আদালতের সিঙ্গল বা ডিভিশন বেঞ্চগুলো বসবে। গত বছরও সংক্রমণ শুরু হতেই সুপ্রিম কোর্টে একাধিক বিচারপতি, কর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন বাড়িতে বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমেই শুনানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। চলতি বছরের শুরুতে দেশজুড়ে টিকাকরণ শুরু হতেই সেই সিদ্ধান্ত কিছুটা শিথিল করা হয়।
আইনজীবীদের জানানো হয়েছিল শুনানিতে প্রয়োজনে তারা আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেন। না চাইলে বাড়িতে বসেও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানিতে অংশগ্রহণ করা যাবে। কী করবেন সেই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ তাদের নিজেদের। এবার কোভিডের সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হতেই ভারতের রাজধানী দিল্লি সহ দেশের একাধিক রাজ্যে আক্রান্তের গ্রাফ উর্ধ্বমুখী। সেই আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরেও।
ফলে সোমবার (১২ এপ্রিল) শীর্ষ আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এবার বিচারপতিরা বাড়িতে বসে ভার্চুয়াল মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করবেন। যেমন আগেরবার করা হচ্ছিল। সেকেন্ড ওয়েভের বাড়বাড়ন্ত শুরু হতেই ফের পুরোনো সেই পদ্ধতি অনুসরণ করা হল। সংক্রমণ না কমা পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।
এদিকে, ক্রমবর্ধিষ্ণু সংক্রমণের নিরিখে ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ অবস্থা মহারাষ্ট্রের। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৩ হাজার ২৯৪ জন। যা এখনও অবধি সর্বোচ্চ। একদিনে সে রাজ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩৪৯ জনের। উত্তরপ্রদেশে দৈনিক আক্রান্ত ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। কর্নাটক, দিল্লি এবং ছত্তীসগঢ়েও সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। তামিলনাড়ু এবং কেরালায় আক্রান্ত সাড়ে ৬ হাজারের বেশি। গুজরাত এবং মধ্যপ্রদেশে আক্রান্ত সাড়ে পাঁচ থেকে ছ’হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। রাজস্থানে তা পাঁচ হাজারের আশপাশে। পশ্চিমবঙ্গেও গত ক’দিনে দৈনিক আক্রান্ত বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে আক্রান্ত হয়েছেন চার হাজারেরও বেশি। অন্ধ্রপ্রদেশ, হরিয়ানা, বিহার, পাঞ্জাবে দৈনিক আক্রান্ত তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের আশপাশে। ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড এবং ওড়িশাতেও দৈনিক আক্রান্ত গত কয়েকদিনে বেড়েছে। হিমাচল প্রদেশ, গোয়াতেও ৫০০-র আশপাশে রয়েছে দৈনিক সংক্রমণ। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে করোনা দ্বিতীয় ঢেউয়ের রেশ তেমন নেই। সিকিমেও সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। গত ক’দিনে সেখানে ২০-২৫ জন করে আক্রান্ত হচ্ছিল। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৫৪ জন। করোনার এহেন সামগ্রিক পরিস্থিতি ভারতকে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ আক্রান্ত দেশে পরিণত করেছে।