নাগর্নো-কারাবাখে জ্বালানি ডিপোতে বিস্ফোরণে নিহত অন্তত ২০
আজারবাইজানের সামরিক অভিযানের পর নাগর্নো-কারাবাখে অঞ্চল থেকে হাজার হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ানদের নির্বাসনের মধ্যে সেখানে একটি জ্বালানি ডিপোতে বিস্ফোরণে কমপক্ষে ২০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে।
নাগর্নো-কারাবাখের আঞ্চলিক স্বাস্থ্য বিভাগের বরাতে আল-জাজিরা জানিয়েছে, সোমবার গভীর রাতে অঞ্চলটির রাজধানী স্টেপানাকার্টের বাইরে ওই বিস্ফোরণের পরে ১৩ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং আহত সাতজনের পরে মৃত্যু হয়েছে।
নাগর্নো-কারাবাখের আঞ্চলিক স্বাস্থ্য বিভাগ আরও বলেছে, ২৯০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে এবং কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। যারা অঞ্চল ছেড়ে যাচ্ছিল, তাদের জ্বালানী দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো ওই জ্বালানি ডিপোটি। বিস্ফোরণের আগে সেখানে শত শত মানুষ জড়ো হয়েছিলো।
আর্মেনিয়ার স্বাস্থ্যসেবা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্য করার জন্য চিকিৎসকদের একটি দল হেলিকপ্টারে ইয়েরেভান থেকে স্টেপানাকার্টের পথে রওনা হয়েছেন। তারা প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন।
আল-জাজিরার সংবাদদাতা ওসামা বিন জাভেদ আজারবাইজানের হোরাদিজ শহর বলেছেন, ‘বিস্ফোরণের কারণে আজারবাইজান ওই অঞ্চলের কাছাকাছি স্থানীয় হাসপাতালগুলো সেবাদানের জন্য প্রস্তুত করেছে এবং আহতদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে। কিন্তু, কারাবাখের আর্মেনিয়ান বাসিন্দাদের প্রতিনিধিরা ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেননি।’
এদিকে, নাগর্নো-কারাবাখ অঞ্চল থেকে হাজার হাজার জাতিগত আর্মেনিয়ান পালাতে শুরু করেছে। আর্মেনিয়া জানিয়েছে, ১৩,৩৫০ বাস্তুচ্যুত মানুষ এরই মধ্যে তার ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে।
আর্মেনিয়া বলেছে, তারা নাগর্নো-কারাবাখ ছেড়ে আসতে চাওয়া ওই আর্মেনিয়ানদের বরণ করে নিতে প্রস্তুত।
আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান রবিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বলেছেন, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার বেসামরিক নাগরিক আর্মেনিয়ায় ঢুকবে, কারণ তারা আজারবাইজানের অংশে থাকতে চায় না এবং জাতিগত নির্মূলের শিকার হওয়ার ভয় পায়।
তিনি বলেন, ‘এই সম্ভাবনা বাড়ছে যে, নাগর্নো-কারাবাখের আর্মেনীয়রা তাদের মাতৃভূমি থেকে অন্যত্র চলে যাওয়াকেই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হিসেবে দেখছে।’
রাশিয়ার নিউজ এজেন্সি তাস জানিয়েছে, পাশিনিয়ান আরও বলেছেন, ‘নাগর্নো-কারাবাখ থেকে আসা আমাদের ভাই ও বোনদের স্নেহের সঙ্গে স্বাগত জানাবে আর্মেনিয়া।’
আর্মেনিয়া জানিয়েছে, গত সপ্তাহে আজারবাইজানের সামরিক অভিযানে ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৪০০ জন আহত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের অংশ হিসাবে স্বীকৃত কিন্তু বর্তমানে আর্টসাখ প্রজাতন্ত্র দ্বারা শাসিত নাগর্নো-কারাবাখের বিচ্ছিন্নতাবাদী যোদ্ধারা আজারবাইজানের সামরিক বাহিনীর ২৪ ঘণ্টার সামরিক অভিযানের পর গত বুধবার একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়৷
আজারবাইনের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ গত বৃহস্পতিবার বিজয় ঘোষণা করে বলেছেন, ‘স্বাধীন নাগর্নো-কারাবাখের ধারণাটি শেষ পর্যন্ত ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ রইল।’
তিনি ওই অঞ্চলে বসবাসরত আর্মেনিয়ানদের অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, আর্মেনীয়দের মধ্যে যারা খ্রিস্টান, তারা চাইলে চলে যেতে পারে।
আজারবাইজান বলেছে, তারা অধিকারের নিশ্চয়তা দেবে এবং ওই অঞ্চলকে একীভূত করবে। কিন্তু, আর্মেনীয়রা বলেছে যে তারা দমন-পীড়নের আশঙ্কা করছে।
কারাবাখ নেতৃত্বের উপদেষ্টা ডেভিড বাবায়ান বলেন, ‘আমাদের জনগণ আজারবাইজানের অংশ হিসেবে থাকতে চায় না। ৯৯ শতাংশ আর্মেনিয়ান আমাদের ঐতিহাসিক ভূমি ছেড়ে যেতে ইচ্ছুক।’
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টর পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা হিকমেত হাজিয়েভ আল-জাজিরাকে বলেছেন, ওই অঞ্চলের বেসামরিক নাগরিকদের রাজনৈতিক একীকরণ, আর্থসামাজিক সমস্যাসহ তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে সরাসরি সংলাপের জন্য বলা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনজীবী শিলা পেলান বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে, আজারবাইজানের শাসনের অধীনে জাতিগত আর্মেনিয়ানদের সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আর্মেনিয়ানদের প্রতি ঘৃণার একটি দীর্ঘস্থায়ী নীতি রয়েছে। এটা শুধু রাতারাতি শেষ হবে না। কারাবাখের আর্মেনিয়ানদের জন্য কোনো নিরাপত্তা বা অধিকার সুরক্ষিত থাকবে বলে বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি নেই। তারা এখন খুব বিপদে আছে।’
এদিকে, নাগোর্নো-কারাবাখে মানবাধিকার ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘের একটি দল মোতায়েনের আহ্বান জানিয়েছে আর্মেনিয়া।
নাগোর্নো-কারাবাখের শরণার্থীদের প্রথম দল রবিবার আর্মেনিয়ায় প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে। তারা কর্নিডজোর আর্মেনিয়ান গ্রামে পৌঁছেছে।
মেট শেন গ্রাম থেকে আসা এক বৃদ্ধ ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের পরিবারগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল। শনিবার আমাদের রাইফেলগুলো নামিয়ে রাখতে হয়েছিল। তাই আমরা চলে এসেছি।’
আজারবাইজান বাহিনীর এক মাসব্যাপী অবরোধ নাগোর্নো-কারাবাখের অনেককে খাদ্য ও জ্বালানিহীন করে ফেলেছিল।
আর্মেনিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাশিয়া থেকে প্রায় ১৫০ টন মানবিক সহায়তা এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি) কর্তৃক পাঠানো আরও ৬৫ টন ময়দা নাগর্নো-কারাবাখে পৌঁছেছে।
আইসিআরসি এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘মানবিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্বাস্থ্য, ফরেনসিক সুরক্ষায় বিশেষ কর্মীদের নিয়ে সেখানে আমাদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছি।’
অন্যদিকে, কূটনৈতিক ফ্রন্টে, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এবং এই অঞ্চলের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ প্রতিনিধির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টারা মঙ্গলবার ব্রাসেলসে বৈঠক করার কথা রয়েছে।