শিল্পকলার প্রতি ইসলাম উদাসীন নয়
অনেকটা নিরবেই গত হয়েছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ইসলামিক আর্ট।’ দিবসটি পালনের বিষয়ে ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তুরস্কের ফার্স্টলেডি এমিনে এরদোয়ানের টুইট বার্তা ছাড়া আর কোনো খবর মেলেনি। অবশ্য করোনার কারণে সেভাবে দিবসটি পালনের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি।
২০১৯ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৪০তম অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়, প্রতি বছর ১৮ নভেম্বর এই দিবস পালন করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে টুইট বার্তায় তুর্কি ফার্স্টলেডি বলেন, ‘১৮ নভেম্বরকে ইন্টারন্যাশনাল ডে অব ইসলামিক আর্ট হিসেবে ঘোষণা করায় আমি ইউনেস্কোকে স্বাগত জানাই।’ এ সময় তিনি আরবি হরফ ‘ওয়াও’ লেখা একটি ছবিও শেয়ার করেন।
এমিনে এরদোয়ান বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে, শিল্পের ক্ষেত্রে ইসলামি সভ্যতার হারিয়ে যাওয়া শোভা আমরা পরিমার্জিতভাবে পুণরুদ্ধার করতে সক্ষম হবো।’
এই শিল্পে তুরস্কের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তুর্কি ফার্স্টলেডি বলেন, ‘আমি মনে করি যে আন্তর্জাতিক ইসলামি আর্ট দিবস এই সম্মানজনক শিল্পকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।’
২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক ইসলামি আর্ট দিবস ঘোষণা করার সময়, ‘ইসলামের অতীত ও সম-সাময়িক শিল্প চর্চা, শৈল্পিক বিষয়ে সচেতনতা এবং ইসলামি সভ্যতার মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতির অবদানকে জাগ্রত করা’ দিবস পালনের লক্ষ্য বলে জানিয়েছিল ইউনেস্কো।
ইউনেস্কো তাদের বিবৃতিতে জানায়, ‘দিবস উদযাপনের মাধ্যমে ইসলামি শিল্পকে কদর করতে উৎসাহ দেওয়া, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় অবদান রাখা এবং জনগণের মধ্যে সহনশীলতা বৃদ্ধির এক শক্তিশালী উপায় তৈরি হবে’ এর মাধ্যমে।
বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে এবার দিবসটি সেভাবে পালিত হয়নি। তবে এটাও সত্য যে, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট দিবসে ইসলামি শিল্পকলা স্মরণ করার মতো বিষয় নয়। এটা বিশাল বিস্তৃত, ঐতিহাসিক ও লম্বা ইতিহাসের উপাখ্যান। যা শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্ববাসী দেখে আসছে, উপকৃত হচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, নানা আয়োজনের মাধ্যমে এসব নিয়ে আলোচনা হলে, বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে, গবেষণা করতে, এর সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে উৎসাহবোধ করবে নতুন প্রজন্ম ও আগ্রহীরা। এর ফলে আরও সমৃদ্ধ হবে ইসলামি শিল্পকলার মাধ্যমগুলো।
কারণ, আল্লাহতায়ালার অফুরন্ত প্রাকৃতিক নিয়ামতের মতো শিল্পকলা সম্পর্কিত প্রতিভাও এক বিশাল নিয়ামত। শিল্পকলার বিকাশ ও প্রসারের ক্ষেত্রে ইসলাম কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না। বিধি-নিষেধ আরোপ করে শুধুমাত্র প্রাণীর প্রতিকৃতি চিত্রায়ন ও নির্মাণের ক্ষেত্রে।
মুসলমানরা ছবি আঁকার পরিবর্তে ক্যালিগ্রাফিকে গ্রহণ করেছে শিল্পকর্ম হিসেবে। বলতে গেলে, এটি তাদের একান্ত নিজস্ব সম্পদ ও ঐতিহ্য। তারা প্রধানত অঙ্কন, কাপড় ও বিভিন্ন দ্রব্য চিত্রায়নের কাজে ক্যালিগ্রাফি ব্যবহার করে। যেসব ক্যালিগ্রাফি দরদ, যত্ন ও নৈপুণ্যের সঙ্গে প্রণীত হয়েছে- সেগুলোর মান খুবই উন্নত। দেখতেও চমৎকার এবং মনোমুগ্ধকর। এগুলোর সৌন্দর্য সত্যিই অবর্ণনীয়।
বিজ্ঞানের বিকাশে কোরআনে কারিমের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, তেমনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে শিল্পকলার উন্নয়নের ক্ষেত্রেও। কোরআনে কারিম মুসলমানদের শিল্পকলার চর্চায় উৎসাহিত করেছে। যেমন, সুন্দর ও সহিহশুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত থেকেই সুললিত উচ্চারণের একটি শাখার উদ্ভব হয়েছে। আবার কোরআনে কারিম সংরক্ষণ প্রচেষ্টা থেকে ক্যালিগ্রাফি, সুন্দর হস্তলিখন, নকশা এবং বাঁধাই শিল্পের সূত্রপাত ঘটেছে। মসজিদ নির্মাণশৈলী থেকে সৃষ্টি হয়েছে স্থাপত্য এবং অলঙ্করণ শিল্পের।
ইসলামি শিল্পকলার মৌলিক উপাদানগুলোর অন্যতম হলো- ক্যালিগ্রাফি, জ্যামিতিক নকশা ও ফুল-পাতার নকশা। টাইলসে অলঙ্করণ, কাঠ খোদাই অথবা কাপড়ের ব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন ভবন, মসজিদ, মাদরাসা, বইপুস্তক, কোরআনে কারিম, জায়নামাজ ইত্যাদিতে ইসলামি শিল্পকলার প্রচলন দেখা যায়। ইসলামি বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন স্থাপনায় এগুলোর ব্যবহার দেখে অনুমান করা যায়, এসব ছিল তখনকার সময়ের অত্যাবশ্যকীয় বিষয়।
নানা সভ্যতার মাঝে ইসলামি শিল্পকলা স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। এটাকে নির্দিষ্ট কোনো শতাব্দী কিংবা সভ্যতার সঙ্গে মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। যুগ চাহিদার সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও ইসলামি শিল্পকলার মৌলিক অনুষঙ্গে কোনো পরিবর্তন হয়নি। শিল্প চর্চার মাধ্যম, উপায়-উপকরণ ইত্যাদিতে আধুনিকায়ন হলেও ইসলামের মৌলিক দর্শন থেকে কখনও শিল্প চর্চাকে আলাদা করা যায়নি।