‘বাজি’র জন্য ভালোবাসা আর হৃদয় নিংড়ানো দোয়া

  • মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, ছবি: বার্তা২৪.কম

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী, ছবি: বার্তা২৪.কম

‘বাজি’। কুমিল্লার আঞ্চলিক শব্দ। সাধারণত ‘বাবা’ শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি আদর করে প্রিয় ছাত্রদের ‘বাজি’ বলে সম্বোধন করতেন, ধীরে ধীরে তার ভালোবাসা মিশ্রিত সম্বোধনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ছাত্ররাও তাকে ভালোবেসে ‘বাজি’ বলতে শুরু করেন। আলেম সমাজে এখন ‘বাজি’ বলতে একজনকেই বুঝায়। তিনি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।

দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে শিক্ষা অর্জন শেষে ‘কাসেমী’ উপাধি ব্যবহারের রীতি রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশে। এ অঞ্চলে হাজারও ‘কাসেমী’ আছেন। কিন্তু বাংলাদেশে হালসময়ে ‘কাসেমী’ বললে একজনকেই বোঝায়। তিনি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তার মতো ‘ছাত্র অন্তঃপ্রাণ’ শিক্ষক খুব একটা দেখা যায় না। ছাত্রদের মধ্যে উস্তাদের প্রতি যে ‘অসাধারণ মুগ্ধতা’ রয়েছে এর নজিরও খুব একটা নেই। ‘বাজি’ সম্বোধনই এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বিজ্ঞাপন

বাজি। ছোট্ট একটি শব্দ। অথচ মায়া-মমতা, নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসা, শাসন-সোহাগের সবকিছু লুকিয়ে আছে এই শব্দের মধ্যে। বাজি উচ্চারণ করলেই হৃদয়ের মণিকোঠায় ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। পৃথিবীর সব শিক্ষকই শ্রেষ্ঠ, তবে তিনি অনন্য, অতুলনীয়। আমি কোনো শিক্ষককে ছোট করছি না। সব শিক্ষকই তার সন্তানসম ছাত্রদের ভালোবাসেন। কিন্তু আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ব্যতিক্রম ছিলেন।

একজন রাজনীতিবিদ, মাঠের নেতা, ক্লাসের শিক্ষক, শায়খুল হাদিস ও পীর হিসেবে তার উদাহরণ তিনিই। তার মতো মমতাসুলভ ব্যবহার সাধারণত অন্যকে করতে দেখা যায় না। তার মতো শাসন-সোহাগ মেশানো সম্বোধন সাধারণত কেউ করেন না। বিভিন্ন সংকট ও উদ্বেগের সময় তিনি যেভাবে নেতাকর্মীদের আগলে রেখেছেন, সদ্য মাওলানা পাশ করা ছাত্রদের কর্মসংস্থানের জন্য চেষ্টা করেছেন- তা বিরল ঘটনা।

বিজ্ঞাপন

‘বাজি’ বলতে বলতে ঠিক কখন থেকে আল্লামা কাসেমী আলেম সমাজের ‘বাজি’ হয়েছেন তা বলা মুশকিল। তবে এই সম্বোধন, এই ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তিনি তিলে তিলে অর্জন করেছেন। এখন ‘বাজি’ বলতে চোখের সামনে তার সদা হাস্যময়ী চেহারা ভেসে ওঠে। আলেম সমাজের জন্য তার দরদের শাশ্বত রূপ বিরল। কওমি মাদরাসা, আলেম সমাজ, মুসলিম উম্মাহর জন্য যে অসামান্য, অমূল্য ও অপরিশোধ্য অবদান তিনি রেখে গেছেন- তা সর্বজনস্বীকৃত।

এটা সত্য যে, সবাইকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। যেকোনো মৃত্যুতেই মানুষ শোকাহত হয়। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু এক ধরনের শূন্যতা সৃষ্টি করে, মানুষকে আশ্রয়হীন করে তোলে- আল্লামা কাসেমীর মৃত্যু এমনই একটি বিষয়। পরিবার কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাইরে তার শিষ্য, গুণগ্রাহী, অনুরক্ত ছাড়াও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তার জন্য চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন। গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

মানুষ মানুষের প্রতি হয় সহানুভূতিশীল, হয় দায়িত্ববান, বাড়িয়ে তোলে নিজের মূল্যবোধের সব অর্জন। তন্মধ্যে মানবিক, সামাজিক ও আদর্শিক মূল্যবোধের মতো গুণ মানুষকে পরিপূর্ণ করে তোলে। এমন মানুষ নিজে জেগে থেকে দেশ ও জাতিকে পাহারা দিতে পারেন, এমনকি জাগিয়ে তুলতে পারেন মানবতাকে। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী তাদেরই একজন।

সমাজ বিনির্মাণে আলোকিত মানুষের অভাব সবকালেই ছিল, এখনও আছে। তবে আল্লামা কাসেমী একটু আলাদা, একটু ভিন্ন, তাকে অন্যের কাছ থেকে আলো ধার করে চলতে হয়নি। বরং জনে জনে নীরবে-নিভৃতে আলো দিতে দিতে তিনি একজন আলোকিত ব্যক্তি থেকে নিজেই হয়ে ওঠেন দিগন্তজোড়া আলোকিত ভুবন। যে ভুবনে নেই অন্ধকার ও লৌকিকতা।

উদার আর নির্মল মনের অধিকারী হিসেবে তিনি শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন ছিলেন। কর্ম ও সাধনাবলে তিনি একজন মানুষ থেকে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। বহমান স্রোতস্বিনী নদীর মতো জীবন কাটিয়েছেন। যে নদী শহরকে করে ক্লেদমুক্ত আর নিজে থাকে স্বচ্ছ কাঁচের মতো। যে নদী বিরামহীন ছুটতে থাকে ক্লান্তি-শ্রান্তি সবকিছু উপেক্ষা করে। যে নদীর বুকে টনে টনে আবর্জনা ঢেলে দেওয়ার পরও কোনো দুঃখ, অভিযোগ কিংবা কোনো অভিমান করে না। তিনি সেই বটবৃক্ষ, যে বটবৃক্ষ দল-মত নির্বিশেষে ছায়া দিয়েছেন অকাতরে।

ইসলামি আন্দোলনের একজন নিবেদিত নেতা হিসেবে নিজের জীবনকে আল্লাহর রাহে বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার স্বপ্ন নিজেকে, নিজের পরিবারকে, নিজের মাদরাসাকে নিয়ে ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল ইসলামি সমাজ বির্নিমাণের, ইসলামি আইন বাস্তবায়নের। মুসলিম উম্মাহর প্রতি তার দায়বদ্ধতা, ছাত্রদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা, নেতাকর্মীদের আগলে রাখা, সহযোগী-সহযোদ্ধাদের মূল্যায়ন, ঐক্য প্রচেষ্টায়- সহনশীল মনোভাব ছিল বিশেষ গুণ।

আল্লামা কাসেমীর পরিচয় অনেক। তবে যোগ্য শায়খ, অভিভাবক, শিক্ষক হিসেবে তার তুলনা তিনিই। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব, জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল এবং অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রোববার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুর সোয়া ১টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। নানা রোগে আক্রান্ত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী কয়েক দিন ধরে ইউনাটেড হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী একজন প্রাজ্ঞ শায়খুল হাদিস। দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শের ধারক-বাহক। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বোখারির দরস প্রদান করেছেন। রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম, ইসলামি শিক্ষা বিস্তার, কওমি মাদরাসার স্বীকৃতি আন্দোলসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে তার মতামত জাতিকে পথ দেখিয়েছে। বিভিন্ন সময় সংগঠিত ঈমানি আন্দোলনে তার অনন্য ভূমিকা ছিল।

তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই, এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। আমরা দারুণভাবে তার শূন্যতাবোধ করবো। আরশের মালিকের কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।