কে হচ্ছেন হেফাজতের মহাসচিব?
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। আল্লামা শাহ আহমদ শফীর হাতেগড়া সংগঠনটির জন্মলগ্ন থেকে আমির ছিলেন তিনি। মহাসচিব ছিলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী।
চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর, আমিরের পদ শূন্য হলে গত ১৫ নভেম্বর হেফাজতের কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সম্মেলনে মহাসচিব আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আমির নির্বাচিত হন। সেই সঙ্গে নতুন মহাসচিব নির্বাচিত হন বারিধারা মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।
মহাসচিব নির্বাচিত হওয়ার ২৮ দিনের মাথায় গত ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ফলে মহাসচিব পদটি পুনরায় শূন্য হয়ে পড়ে। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর মৃত্যু ৯ দিন পরও কাউকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
আনুষ্ঠানিকভাবে হেফাজতের মহাসচিব নির্বাচনের কোনো প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। তবে আলোচনা চলছে নানা পর্যায়ে। নবগঠিত কমিটির সদস্যরা বৈঠক করে কাউকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেবেন, অথবা প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কাউকে নির্বাচন করা হবে- এটা নিয়েও চলছে আলোচনা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হেফাজতের এক কেন্দ্রীয় নেতা বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, ‘এই মুহূর্তে নতুন কাউন্সিল করার সম্ভাবনা নেই। আপাতত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করে কাউকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।’
১৫ নভেম্বর হেফাজতের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আলোচনা শেষে কয়েকটি পদ ফাঁকা রেখে ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে ৩২ জন নায়েবে আমির, ৪ জন যুগ্ম-মহাসচিব ও ১৮ জন সহকারী মহাসচিব রয়েছে।
বর্তমান কমিটিতে যুগ্ম-মহাসচিব হিসেবে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক, মাওলানা লোকমান হাকিম ও মাওলানা নাসির উদ্দিন মুনির রয়েছেন।
‘তবে এই চারজনের মধ্যে কোনো একজন দায়িত্ব পেতে পারেন- এটা নিশ্চিত নয়’ বলছিলেন চট্টগ্রামের এক হেফাজত নেতা। তার মতে, ‘তাহলে, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর মৃত্যুর পর পরই সাধারণ নিয়ম মেনে এই চারজনের কাউকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হতো।’
তাহলে কে হবেন হেফাজত ইসলামে পরবর্তী মহাসচিব? এটা নিয়ে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা ও জল্পনা-কল্পনা। তবে হেফাজতের এক নায়েবে আমির বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘যুগ্ম-মহাসচিব নয়, বরং নায়েবে আমিরদের মধ্যে দক্ষ সংগঠক ও তুলনামূলকভাবে বিতর্কমুক্ত কাউকে মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।’ এই নায়েবে আমিরের মতে, মহাসচিব হবেন রাজধানীকেন্দ্রিক।
হেফাজতে ইসলামের নানা স্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জানা গেছে, সম্ভাব্য মহাসচিব হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন- নায়েবে আমির মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মাওলানা সাজিদুর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ (পীর সাহেব মধুপুর), মাওলানা সালাউদ্দিন নানুপুরী, মাওলানা আবদুল আওয়াল, যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক।
মহাসচিব হিসেবে নায়েবে আমির মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদীর সম্ভাবনা বেশি। খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা নুরুল ইসলাম বর্তমানে বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের সহ-সভাপতি, হাইয়াতুল উলইয়ার সদস্য এবং তাহাফফুজে খতমে নবুওয়তের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হেফাজতের সাংগঠনিক কাঠামো, দায়িত্বের বিশালতা আর নির্ভরশীলতার বৃহত্তর জায়গা থেকে চিন্তা করলে তিনি মহাসচিব হওয়ার দৌঁড়ে সবচেয়ে এগিয়ে। ঢাকায় বসবাস করলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সন্তান তার জন্য বাড়তি সুবিধা বয়ে এনেছে।
আর তরুণ প্রজন্মের পছন্দের তালিকায় রয়েছেন মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক। ভাস্কর্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা-মামলা, হেফাজতের পুরোনো মামলা সচল এবং আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর তিন মাস পর তাকে হত্যার অভিযোগে মামলাসহ নানা কারণে আলোচনায় রয়েছেন তিনি। যদিও বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, নিজের হাতেগড়া সংগঠন যুব মজলিস ও খেলাফত মজলিস নিয়ে তিনি আপাতত ভাবছেন।
মহাসচিব হিসেবে এক নম্বর যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবের নামও বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের মাঝে তাকে নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তি ও চাপা ক্ষোভ রয়েছে। ২০১৩ সালে ঢাকার মতিঝিলে অবস্থান কর্মসূচিকে ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনা এবং তারপরে পুলিশের নজিরবিহীন সাঁড়াশি অভিযানের পর সংগঠনটির বিরুদ্ধে মামলার খড়গ নেমে আসে। তখন ঢাকাসহ সারা দেশে হেফাজতের বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা হয়। এ সময় তার লন্ডন গমন এবং আল্লামা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর এক স্মরণসভায় তার ভাষণ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় তাকে হেফাজতের মতো একটি সংগঠনের দায়িত্বে আনা কতটা ঠিক হবে তা ভাবনার বিষয়।
উল্লেখ্য, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব ছাড়া বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব এবং বারিধারা মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মৃত্যুর পর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন হাফেজ মাওলানা নাজমুল হাসান, জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হয়েছেন মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী এবং বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস।