১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় হিজাব দিবস ঘোষণা ফিলিপাইনের
ফিলিপাইনের আইনসভা যুগান্তকারী একটি প্রস্তাব পাস করেছে। অনুমোদিত প্রস্তাবে দেশটিতে ১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় হিজাব দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-আটরণ ও অনুশীলনের ‘গভীর উপলব্ধি’ ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি দেশটিতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে সহনশীলতা তৈরির লক্ষ্য নিয়ে এই প্রস্তাবটি পাস করা হয়।
ফিলিপাইনের আইনসভার ২০৩ সদস্যের সবাই ২৬ জানুয়ারি এক অধিবেশনে প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। প্রস্তাবটির উত্থাপক আনাক মিন্দানাও পার্টির পক্ষ থেকে আইনসভার সদস্য আমিহিলদা সাঙ্গকোপান সমর্থনের জন্য সব সদস্যকেই ধন্যবাদ জানান।
ফিলিপাইনের মুসলিম নারীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা, দেশজুড়ে সহনশীলতা, অন্য বিশ্বাস ও জীবনধারাকে স্বীকৃতি দেওয়ার মানসিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে এই প্রস্তাব আনা হয়েছে।
সাঙ্গকোপান বলেন, ‘বিশ্বজুড়ে হিজাবি নারী বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। ফিলিপাইনের কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কিছু ছাত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হিজাব ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। কেউ বা অধ্যয়ন ছেড়ে দিতে বা অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছেন। এটি ওই শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন।’
এই প্রস্তাবটি ফিলিপাইনে হিজাবী নারীদের বিরুদ্ধে বৈষম্য দূর করবে বলেও অভিমত জানিয়েছেন ফিলিপাইনের আইনসভার এই সদস্য।
আমিহিলদা সাঙ্গকোপান বলেন, ‘হিজাব পরা প্রত্যেক মুসলিম নারীর অধিকার। এটি সাধারণ কোনো কাপড় নয়, বরং এটি তাদের জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ। মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থেই এর বর্ণনা এসেছে। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক মুসলিম নারী যেন তাদের সৌন্দর্য ঢেকে শালীনভাবে চলে।’
ইউনাইটেড রিলিজিয়নস ইনিশিয়েটিভস গ্লোবাল কাউন্সিলের ট্রাস্টি ড. পোতরে দিরামপাতান দিয়ামপুয়ান ফিলিপাইনের আইনসভার এই পদক্ষেপকে ‘মাইলফলক’ উল্লেখ করে স্বাগত জানান। তিনি বলেন, ‘সকলকে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার এটি এক অনুশীলন। আমি মনে করে মুসলিম সম্প্রদায় একে স্বাগত জানাবে।’
প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের পরই আইনসভায় পাস হওয়া এই প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হবে।
ইসলাম ফিলিপাইনের দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম। বর্তমানে দেশটির ১১ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। এদের বেশিরভাগই দক্ষিণের মিন্দানাও দ্বীপপুঞ্জে বসবাস করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিপাইন স্বাধীন হয়। ফিলিপাইনে ইসলামের প্রসার ঘটে আরব ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। তাদের ইসলামি জীবনযাত্রা ও আখলাক-চরিত্র দেখে ফিলিপাইনের আধিবাসীরা ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ হন।
ফিলিপাইনে অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ রয়েছে। শেখ করিম আল মাখদুম মসজিদটি ফিলিপাইনের প্রথম মসজিদ। যা মিন্দানাওয়ের সিমুনুল প্রদেশের তুবিগ ইন্দানগানে অবস্থিত। আরেকটি বিখ্যাত মসজিদ হলো- পিঙ্ক মসজিদ। শান্তি এবং ভালোবাসার রঙে সাজানো মসজিদটি মগুইন্দানো প্রদেশের দাতুসৌদি আম্পাতাউন শহরে অবস্থিত। মসজিদের বর্ণিল রঙ একে অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনা থেকে আকর্ষণীয় এবং ব্যতিক্রম হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
ম্যানিলার গোল্ডেন মসজিদও ঐতিহাসিক একটি মসজিদ। ফিলিপাইনের মসজিদগুলোর সঙ্গে রয়েছে ইসলামিক সেন্টার ও অতিথিশালা।
ফিলিপাইনে আড়াই হাজারের মতো মসজিদ রয়েছে। মসজিদ ছাড়াও প্রায় ১২০টির মতো ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র, প্রচুর দাতব্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফিলিপাইনের মুসলমানরা দাওয়াতে তাবলিগের কাজে সক্রিয়।
কয়েক বছর ধরে ফিলিপাইনে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ঈদুল আজহার ছুটি দেওয়া হয়। দেশটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে হালাল খাবারের দোকান। মুসলমানরা তাদের ঐতিহ্য বজায় রেখে রমজানও পালন করতে পারেন। তারাবির নামাজে খতমে কোরআনের ব্যবস্থা হয় অনেক মসজিদেই।
সম্প্রতি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ফিলিপাইনের বেশ কয়েকটি প্রাচীন মসজিদ সংস্কারের জন্য সরকার ১০ লাখ ডলার বরাদ্দ দিয়েছে। ধর্মীয়ভাবে সহাবস্থানের জন্য ফিলিপাইনের বেশ সুনাম রয়েছে। এমন প্রেক্ষিতে দেশটিতে হিজাব দিবস পালনের ঘোষণা বেশ তাৎপর্যময়।
এক বাংলাদেশী নারীর আহ্বানে ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক হিজাব দিবস পালন শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত নাজমা খান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সর্বপ্রথম হিজাব দিবস পালনের পক্ষে প্রচারণা চালান। এর ধারাবাহিকতায় পরে মুসলিম দেশগুলোতে দিবসটি পালনের প্রচলন শুরু হয়। শুরু হওয়ার পরপরই হিজাব দিবস বিশ্বজুড়ে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম বছর ৬৭টি দেশের মুসলিম নারীরা ছাড়াও খ্রিস্টান, ইহুদি, হিন্দু, বৌদ্ধ এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও হিজাব দিবস পালন করেন।
এবার ১৫০টি দেশে পালিত হয়েছে নবম বিশ্ব হিজাব দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘আমাদের গর্বকে আপনার কুসংস্কার বানাবেন না, হিজাবভীতি বন্ধ করুন।’ করোনা মহামারির কারণে এবার দিবসটি ভার্চুয়ালি উদযাপিত হয়েছে।
এবারের প্রতিপাদ্যটিকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে অভিহিত করা হয়েছে। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হিজাব নিষিদ্ধ। অনেক মুসলিম নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে সহিংসতার শিকার। হিজাব বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা, শিক্ষা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে সবার সম্পর্ক তৈরি করাই হলো- মূল লক্ষ্য।
এবারের বিশ্ব হিজাব দিবসে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে রাস্তায় ফুল বিতরণ করেছে দেশটির মুসলিম নারীদের সংগঠন। অনেক দেশে হিজাব বিনিময় ও উপহার হিসেবেও দেওয়া হয়েছে।
হিজাবকে সাধারণত নারীর প্রতি নিপীড়ন ও বৈষম্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এই বৈষম্যের অবসান ঘটানোর উদ্দেশ্য নিয়েই দিবসটির উদ্যোক্তা অমুসলিমদেরও হিজাব পরার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বাস্তবেই এটাকে সত্যিই কোনো নিপীড়ন কি-না, তা বোঝানোর জন্য হিজাব দিবস পালনের ডাক দেন।
বিশ্ব হিজাব দিবস পালনের মধ্য দিয়ে হিজাব বিষয়ে সবাইকে সচেতন করতে পারে বলে মত দেন সংশ্লিষ্টরা। এই দিবস নারীদের এই সুন্দর লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে।