আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলী
আল্লাহতায়ালা মানুষকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। জ্ঞান-গরিমা, বিদ্যাবুদ্ধি, কার্যদক্ষতা ও জীবনব্যবস্থা থেকে শুরু করে সবদিক থেকে মানুষ অন্যসব সৃষ্টি থেকে ব্যতিক্রম। জীবন ও জগতের সবকিছুতে মানুষের স্বকীয়তা-অনন্যতা ও বৈশিষ্ট্য দেদীপ্যমান। আল্লাহ মানুষকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ এমনকিছু গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন- যা পৃথিবীর সব সৃষ্টি থেকে মানুষকে সামগ্রিকভাবে আলাদা করে তুলেছে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি আদম সন্তানদের মর্যাদাশীল করেছি।’ –সুরা বনি ইসরাইল: ৭০
কোরআনে কারিমে আরও ইরশাদ হচ্ছে, ‘আমি মানুষকে সুন্দরতম গঠন দিয়ে তৈরি করেছি।’ -সুরা আত-ত্বীন : ৪
এভাবে পবিত্র কোরআনের বিভিন্নস্থানে আল্লাহতায়ালা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বস্তুত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হলো- ঈমানদারগণ। তবে ঈমানদারদের স্তরে তারতম্য রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা মানবজগতের মধ্যে বিশেষ মর্যাদাবান। তারা সকল প্রকারের কাজ, ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য কামনা করেন এবং প্রতিনিয়ত নিজেদের প্রভুর সামনে নিজেকে আত্মসমর্পিত রাখেন। ফলে তারা আল্লাহর সমধিক ভালোবাসা ও করুণা লাভে ধন্য হন।
তাদের মধ্যে বিশেষ কিছু গুণাবলী এমন রয়েছে যেগুলোর ফলে মহান আল্লাহ তাদেরকে অত্যাধিক ভালোবাসেন এবং তাদের প্রতি বিশেষ করুণা করেন। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো-
আল্লাহর পূর্ণ দাসত্ব
মানুষ যেহেতু আল্লাহর ‘আবদ’ বা দাস, সে হিসেবে দাসের কাজ হচ্ছে- সদা প্রভুর আদেশ-নিষেধের অনুগত থাকা। প্রভুর সামনে দাসের আশা-আকাঙ্খা কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলতে কিছু থাকে না। তার সব কিছু আল্লাহর মর্জির ওপর নির্ভরশীল হয়। যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রকৃতপক্ষে বান্দা হওয়ার যোগ্য, সে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছাধীন ছেড়ে দেয় এবং সর্বদা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অবনত মস্তকে পালন করে। বস্তুতপক্ষে একজন খাঁটি মুমিনের প্রথম পরিচয় হবে, আল্লাহর হুকুম-আহকাম সর্বোতভাবে ও অকুণ্ঠচিত্তে মেনে চলা।
শিরক থেকে বেঁচে থাকা
আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্যতম গুণ হলো- আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ডাকে না। ‘শিরক’ করা বা কোনো কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করা সবচেয়ে মারাত্মক গোনাহ। আল্লাহতায়ালা সব গোনাহ মাফ করলেও শিরকের গোনাহ মাফ করবেন না। হজরত লোকমান (আ.) তার ছেলেকে উপদেশ দিয়েছেন, ‘হে পুত্র! তুমি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শিরক করো না। নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় গোনাহ।’ -সুরা লোকমান : ১৩
পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করা
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর বান্দা হলো- তারা, যারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ -সুরা ফুরকান : ৬৩
অর্থাৎ তাদের চালচলনে বিনয়, নম্রতা ও নিরহঙ্কার প্রকাশ পায়। আত্মগরিমা ও দাম্ভিকতা দেখা যায় না। তাদের দৃষ্টি নিম্নগামী হয়ে থাকে এবং তারা দৃঢ় পদক্ষপে পথ চলে। আল্লাহভীতির কারণে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদা নমনীয় থাকে এবং যত্রতত্র সেগুলোর অনাধিকার চর্চা থেকে বেঁচে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তারা দুর্বল-ভীরু কিংবা অক্ষম নয়। বরং আল্লাহভীতি ও আখেরাতের চিন্তা তাদের অতি নম্র, সহনশীল এবং নমনীয় ও স্বল্পভাষী করে রাখে।
মূর্খদের আচরণের বিপরীতে শান্তির বার্তা
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মুর্খেরা যখন তাদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডা করে তখন তারা বলে, তোমাদের ওপর সালাম বা শান্তি বর্ষিত হোক।’ -সুরা ফুরকান : ৬৩
এখানে সালামের অর্থ মুসলমানেরা পরস্পর দেখা-সাক্ষাতে অভিবাদন জানানের ধর্মীয় সালাম নয়। বরং ওই মূর্খের শান্তি-সুখ ও নিরাপত্তা কামনা করা এবং বুঝিয়ে দেওয়া যে, তোমার অজ্ঞতাপ্রসূত আচরণের জবাব আমি মূর্খতা দিয়ে দেব না। তোমার সঙ্গে ঝগড়াও করব না। বরং তোমার শান্তি-সমৃদ্ধি ও মঙ্গল হোক, সেটাই আমি কামনা করি। আল্লাহতায়ালা অন্য জায়গায় বলেছেন, ‘ভালো ও মন্দ কখনও সমান হতে পারে না। মন্দকে ভালো আচরণ দ্বারা প্রতিহত করো। অতএব যার সঙ্গে তোমার শত্রুতা রয়েছে, সে হয়তো তোমার পরমপ্রিয় বন্ধু হয়ে ওঠবে।’ -সুরা ফুসসিলাত : ২৫
সিজদা ও নামাজরত অবস্থায় রাত কাটানো
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা তাদের রবের ইবাদতে সিজদা ও দণ্ডায়মান অবস্থায় রাত্রিজাগরণ করে।’ -সুরা ফুরকান : ৬৪
যারা ইবাদতের নিমিত্তে নিদ্রা ও শয্যা ত্যাগ করে রাত্রিজাগরণ করে, তারা নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রিয় বান্দা। শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সকল রাতের নেক বান্দাদের অভ্যাস ছিল। এ নামাজ মুমিনের মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করে। প্রভূর সঙ্গে সম্পর্ককে দৃঢ় ও মজবুত করে। অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের পার্শ্বদেশ শয্যা থেকে পৃথক থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে আশা ও আশঙ্কায় ডেকে থাকে এবং তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।’ -সুরা সিজদা : ১৬
আল্লাহর নিষ্ঠাবান বান্দারা রাতে বিছানা ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন হয়। প্রভুর করুণা ও পুণ্য লাভের আশায় তারা নামাজ-জিকির এবং ইস্তেগফার করে।
আরেকটি গুণ হলো, ‘তারা যখন খরচ করে তখন তারা অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না। বরং মধ্যপন্থা অবলম্বন করে।’ -সুরা ফুরকান : ৬৭
শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে অপাত্রে খরচ করাকে অপব্যয় বলে। যদিও তা অতি সামান্য হোক। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা অপব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না।’ কোরআনে কারিমের অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ২৭