ভূমিকম্প আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা
এই নিখিল বসুন্ধরার বিভিন্ন প্রান্তে সময়ে সময়ে ভূমিকম্প হয়। কোথাও তীব্রতা বেশি, কোথাও কম। মূলতঃ ভূমিকম্প হলো- মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা। যেন মানুষ নিজের অপরাধের জন্য তওবা করে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘(হে নবী) আপনি বলুন! তিনিই (আল্লাহ) শক্তিমান যে, তোমাদের ওপর কোনো শাস্তি ওপর দিক থেকে অথবা তোমাদের পদতল থেকে প্রেরণ করবেন অথবা তোমাদেরকে দলে-উপদলে বিভক্ত করে সবাইকে মুখোমুখি করে দেবেন এবং এককে অন্যের ওপর আক্রমণের স্বাদ আস্বাদন করাবেন। দেখ, আমি কেমন ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিদর্শনাবলী বর্ণনা করি যাতে তারা বুঝে নেয়।’ -সুরা আনআম : ৬৫
বর্ণিত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইস্পাহানি (রহ.) বলেন, ‘আসমান থেকে আজাব অবতীর্ণের মমার্থ হলো- তীব্র শব্দ, পাথর অথবা ঝড়ো হাওয়া; আর পায়ের নীচ থেকে আজাব প্রেরণের ব্যাখ্যা হলো- ভূমিকম্প এবং ভূমি ধ্বসের মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যাওয়া।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে কাইয়্যুম বলেন, আল্লাহতায়ালা মাঝে-মধ্যে পৃথিবীকে জীবন্ত হয়ে ওঠার অনুমতি দেন। ফলে বড় ধরনের ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তখন এই ভূমিকম্প মানুষকে ভীত করে। ফলে মানুষ আল্লাহর নিকট তওবা করে, পাপকর্ম ছেড়ে দেয়, আল্লাহর প্রতি ধাবিত হয় এবং তাদের কৃত পাপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে।
ভূমিকম্প বিষয়ে কোরআনে কারিমে দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হলো- ‘যিলযাল’ (একটি বস্তুর নড়াচড়ায় অন্য আরেকটি বস্তু নড়ে ওঠা) দ্বিতীয় শব্দটি হলো- ‘দাক্কা’( প্রচণ্ড কোনো শব্দ বা আওয়াজের কারণে কোনো কিছু নড়ে ওঠা বা ঝাঁকুনি খাওয়া)। পৃথিবীতে বর্তমানে যেসব ভূমিকম্প ঘটছে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে তা ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাস্তরের স্থানান্তরের কারণে ঘটছে।
কেয়ামতের দিন আরেকটি ভূমিকম্পে পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ধুলিকণায় পরিণত হবে এবং তা হবে হজরত ইসরাফিল (আ.)-এর সিঙ্গায় ফুৎকারের কারণে, যাকে বলা হয়- ‘দাক্কা’। যা হবে এক প্রচন্ড আওয়াজ।
পৃথিবীতে মাঝে মাঝে কঠিন শিলাস্তরের স্থানান্তরের কারণে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্প এ কথার প্রতি ইংগিত করে, একদিন ওই ‘দাক্কা’ সংঘটিত হবে, যার নাম কেয়ামত। তখন এই চাকচিক্যময় দুনিয়ার সবকিছুই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। মানুষ যেন কেয়ামতকে ভুলে না যায়, ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াকে তার আসল ঠিকানা মনে না করে, সেই লক্ষ্যে মহান আল্লাহ ভূমিকম্পসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করেন।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ভূমিকম্পের হার বেড়ে গেছে। ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। কার্যত প্রাকৃতিক নানান বিপর্যয় মানুষের পাপ ও অপরাধের ফল। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে বিপদ-আপদই তোমাদের ওপর আসুক না কেন, তা হচ্ছে তোমাদের নিজেদের হাতের উপার্জন।’ -সুরা শূরা : ৩০
আর এগুলোর পথ ধরেই মানুষ কেয়ামতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘আমার উম্মত যখন নিম্নোক্ত কাজে লিপ্ত হবে, তখন তাদের প্রতি বালা-মসিবত আপতিত হতে থাকবে। কাজগুলো হলো- ১. গণিমতের মাল ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে। ২. অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে। ৩. আমানতের খেয়ানত করা হবে, ৪. ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যার্জন করা হবে, ৫. পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়ে মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, ৬. বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা হবে, আর পিতার সঙ্গে করা হবে জুলুম, ৭. জাকাত আদায়কে জরিমানা আদায়ের ন্যায় মনে করবে, ৮. মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল (কথাবার্ত) হবে, ৯. অসাম্মানীয়রা সমাজের শাসক কিংবা নেতা হবে, ১০. ব্যক্তিকে সম্মান করা হবে তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য, ১১. প্রকাশ্যে মদপান করা হবে, ১২. পুরুষ রেশমি পোশাক পরিধান করবে, ১৩. গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের সয়লাব হবে, ১৪. জ্ঞান উঠিয়ে নেওয়া হবে, ১৫. পূর্ববর্তী উম্মতদের (সাহাবা, তাবে-তাবেঈন) প্রতি অভিসম্পাত করা হবে... ওই সময় তোমরা রক্তিম বর্ণের ঝড়ের (এসিড বৃষ্টি), ভূকম্পনের, ভূমিধসের, রূপ বিকৃতির (লিঙ্গ পরিবর্তন), পাথর বৃষ্টি প্রভৃতির জন্য অপেক্ষা করো। আর কেয়ামতের ভয়াবহতা প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও মারাত্মক।’ ইরশাদ হচ্ছে, ‘(যেদিন কেয়ামত হবে) প্রবল কম্পনে প্রকম্পিত হবে পৃথিবী এবং পর্বতমালা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে তা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত হবে।’
করণীয়
তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা : এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনতো এবং (আল্লাহকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ তাই যখন কোথাও ভূমিকম্প হয় অথবা সূর্যগ্রহণ কিংবা ঝড়ো বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে অতি দ্রুত তওবা করা এবং আল্লাহকে বেশি পরিমাণে স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যদি তুমি এরকম কিছু (উপরোক্ত বিষয়াবলী) দেখে থাকো, তখন দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহকে স্মরণ করো, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো।’
দয়া প্রদর্শন ও দান-সদকা : প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে মুক্তির জন্য দরিদ্র ও মিসকিনদের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং তাদের দান করা উচিত। কেননা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যারা দুনিয়াবাসীর প্রতি দয়া প্রদর্শন করে, মহান আল্লাহ তাদের প্রতি দয়া দেখাবেন। আর হজরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তার শাসনামলে যখন ভূমিকম্প হতো তখন তার গভর্নরদের দান-সদকা করার প্রতি জোর দিয়ে চিঠি লিখতেন।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : সমাজে প্রচলিত জিনা-ব্যভিচার, অন্যায়-অবিচাররোধ করার মরণপণ প্রচেষ্টা করা ভূমিকম্প থেকে পরিত্রাণের অনন্য হাতিয়ার। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমাদের মধ্যে যদি কেউ গর্হিত কাজ দেখতে পায়, সে যেন তা হাত দিয়ে শক্তি প্রয়োগ করে তা প্রতিহত করে, আর যদি না পারে তবে বক্তব্যের মাধ্যমেই জনমত সৃষ্টি করে তা প্রতিহত করে, আর সামর্থ্য না থাকলে অন্তর দিয়ে ওই কাজকে ঘৃণা করে, আর এটাই ঈমানের দুর্বলতম স্তর।’
বস্তুত ধেয়ে আসছে আরও ভয়াবহ ভূমিকম্প ও রক্তিম পাথর বৃষ্টি। তাই কালক্ষেপণ না করে নিজেদের শুধরে নেওয়া উচিত। ইরশাদ হচ্ছে, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা হচ্ছে একে অপরের বন্ধু। এরা (মানুষদের) ন্যায় কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে, তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত আদায় করে, (জীবনের সব কাজে) আল্লাহতায়ালা ও তার রাসুলের (বিধানের) অনুসরণ করে, এরাই হচ্ছে সে সব মানুষ; যাদের উপর আল্লাহতায়ালা অচিরেই দয়া করবেন; অবশ্যই আল্লাহ পরাক্রমশালী, কুশলী।’