বক্তব্যে রূঢ়তা ও অভিশাপ ইসলামের শিক্ষা নয়
মানুষকে ইসলাম ও সৎ পথে উদ্বুদ্ধ করা কিংবা জ্ঞান বিতরণের অন্যতম উপায় হচ্ছে বয়ান, বক্তৃতা বা আলোচনা। বক্তৃতার মধ্যে মোহনীয় ও আকর্ষণীয় প্রভাব থাকায় তা মানুষকে দ্রুত প্রভাবিত করে এবং অন্তরকে আকৃষ্ট করে। হজরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয়ই কোনো কোনো বক্তৃতায় জাদুর মতো প্রভাব থাকে।’ –সহিহ বোখারি : ৫৪৩৪
তবে বক্তৃতার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়ালা রাখা জরুরি। যেন বক্তব্যে কোনো অবস্থায় অপ্রয়োজনীয়, অশালীন, চাটুকারিতা ও অসত্য কথা প্রকাশিত না হয়। সে ক্ষেত্রে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর উত্তম জীবনাদর্শ অবশ্যই অনুকরণীয়।
ইসলামি স্কলারদের মতে, বক্তৃতা দেওয়ার সময় নম্রতা অবলম্বন করা জরুরি। রূঢ়তা ও কর্কশতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। সেই সঙ্গে একাই বক্তৃতা দেওয়ার মানসিকতাও পরিহার করা। অনেকেই আছেন, কেবল নিজেই অধিক কথা বলতে বেশি পছন্দ করেন। অন্যকে কথা বলার সুযোগ কম দেন। এরূপ মানসিকতা পরিহার করা আবশ্যক। বরং অন্যের কথা শুনতে হবে ও তাদেরকে বলার সুযোগ দিতে হবে। আর কোনো মজলিসে কথা বলার ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠকে প্রাধান্য দিতে হবে।
বক্তৃতার মধ্যে তর্ক-বিতর্ক ও বাচালতা পরিহার করা ইসলামের শিক্ষা। কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কথা বলা বা বাচালতা অনুচিত। এগুলো মানুষ পছন্দ করে না। ভান করে বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কথা বলাও ঠিক নয়। সহজ-সরলভাবে কথা বলা মুমিনের জন্য জরুরি। সেই সঙ্গে অহেতুক তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলা উচিত। অশ্লীল কথা বলা বা কথাবার্তায় অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করাও মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলো একেবারেই পরিত্যাজ্য। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনও কোনো বক্তৃতায় অশ্লীল শব্দ প্রয়োগ করেননি।
আরও পড়ুন : ওয়াজ যেমন হওয়া চাই
বক্তৃতায় বাগ-বিতণ্ডা পরিহার করা আবশ্যক। তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়া বা বাগ-বিতণ্ডা কখনও ভালো ফল বয়ে আনে না। কাজেই অপ্রয়োজনে এসব থেকে দূরে থাকা একান্ত জরুরি। বক্তৃতার ক্ষেত্রে খুব করে খেয়াল রাখা, কারও শোনা কথা ও তথ্য যাচাই ছাড়া না বলা। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বক্তৃতা দিতেন, তখন তিনি তথ্যবহুল কথা বলতেন কারও শোনা কথা যাচাই না করে বলতেন না। তাই কারও নিকট থেকে শোনা কথার সত্যাসত্য যাচাই না করে বলা উচিত নয়। কেননা এতে পাপী ও মিথ্যাবাদী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির পাপী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোনো কথা শোনামাত্রই (যাচাই না করে) বলে বেড়ায়।’ –সুনানে আবু দাউদ : ৪৯৯২
অন্যত্র তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।’ –সহিহ মুসলিম : ৫
বক্তৃতায় অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক কথা পরিহার করতে হবে। কেননা এতে কোনো উপকারিতা নেই। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য হচ্ছে, তার অনর্থক কথাবার্তা পরিহার করা।’ –ইবনে মাজাহ : ৩৯৭৬
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জীবনের অসংখ্য বক্তৃতা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো বক্তৃতায় একটি অনর্থক অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার করেননি। এমনকি রাসুলুল্লাহ (সা.) মানহানিমূলক কোনো বক্তৃতাও দিতেন না। ইসলামের পরিভাষায় ‘ইফতিরা’ হলো- কোনো ব্যক্তির ওপর মিথ্যা দোষারোপ করা, ক্ষতি সাধনের লক্ষে কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ করা অথবা কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে কল্পিত মিথ্যা কথা বলা। কোরআনের ব্যবহার রীতি অনুযায়ী ইফতিরা হলো- মিথ্যা কথা বলার সমার্থক। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ইসলামের দিকে আহ্বান করা সত্ত্বেও, যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে তার অপেক্ষা অধিক জালিম আর কে? আল্লাহ জালেম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।’ -সুরা সফ : ৭
মানহানিকর বক্তব্য, মিথ্যা কথা ও মিথ্যা অভিযোগ হচ্ছে- বাকস্বাধীনতার লংঘন যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সুতরাং মানহানিকর সকল কথা ও কর্ম হতে বিরত থাকা সকলের কর্তব্য। মুসলমানদের সব কাজ হতে হবে রাসুলের আদর্শ অনুযায়ী।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত দিয়ে কোনো বক্তৃতা দিতেন না। অভিশাপ বা অভিসম্পাত হচ্ছে, সাধারণত অসন্তোষের প্রকাশ এবং অভিশাপ হচ্ছে প্রচণ্ড ক্রোধজনিত অমঙ্গল কামনা। প্রায়ই অভিশাপের কথা উচ্চারণ ও কোনো ব্যক্তির ওপর আল্লাহর রোষানলে পতিত হোক, এমন কথা বলে অভিসম্পাত করা হয়ে থাকে, যেমন, তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক। সে অভিশাপের রোষানলে জ্বলে-পুড়ে মরুক। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনও অভিসম্পাত দিয়ে কোনো বক্তৃতা দিতেন না।