শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের অগ্রযাত্রা
শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র এবং সার্কের সদস্য। ১৯৭২ সালের আগে এই দ্বীপ সিলোন নামে পরিচিত ছিল। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বো এবং এটি প্রধান শহর। প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলঙ্কা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। সিংহলি সম্প্রদায় এই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উত্তর দিকের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তামিল সম্প্রদায় দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে মুর, বার্ঘের, কাফির ও মালয় উল্লেখযোগ্য। শ্রীলঙ্কা চা, কফি, নারকেল, রাবার উৎপাদন ও রফতানিতে বিখ্যাত।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসংবলিত সমুদ্রসৈকত, সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শ্রীলঙ্কাকে সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এর ভৌগোলিক অবস্থান এবং ‘গভীর আশ্রয়স্থল’ প্রাচীন সিল্ক রোডের সময় থেকে আধুনিক মেরিটাইম সিল্ক রোড পর্যন্ত একে অত্যন্ত কৌশলগত গুরুত্ব দিয়েছে।
সিংহলি সম্প্রদায় শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা ‘মুর’ নামে পরিচিত। পরিসংখ্যান অনুযায়ী তারা দেশটিতে তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগত সম্প্রদায়। দেশটির মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশের অধিক মুসলমান। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় এক হাজার ৫০০ মসজিদ, ১০০ কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র এবং দুই শতাধিক মাদরাসা ও স্বতন্ত্র ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে যেগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত।
মূলত শ্রীলঙ্কার মুসলিম জনগোষ্ঠী দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। দেশটিতে রয়েছে ঐতিহাসিক ও প্রাচীন অনেক মসজিদ। শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চল ডাম্বুল্লার সবচেয়ে বড় মসজিদের বয়স ৬০ বছরের বেশি। কেটচিমালাই মসজিদটি শ্রীলঙ্কার বেরুওয়ালায় অবস্থিত। সাদা, লম্বা ও উঁচু মিনারের এ মসজিদের চার দিক নারকেল গাছ দিয়ে বেষ্টিত। প্রাচীন আরবি স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত মসজিদটি দূর থেকে দেখতে অনেকটা ছবির মতো মনে হয়। দেশটিতে দাওয়াতে তাবলিগের কাজ ব্যাপকভাবে চালু আছে। তাবলিগের মারকাজ গ্র্যান্ডপাস রোডের মসজিদটিও বেশ বিখ্যাত।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশটিতে মুসলমানরা এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বাড়ছে মুসলিমবিদ্বেষও। দেশটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে বাড়ছে মুসলিম স্থাপনা ও অবকাঠামো। রাজনীতিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাজনৈতিক দল ‘শ্রীলঙ্কান মুসলিম কংগ্রেস’ বেশ প্রভাবশালী। অন্য রাজনৈতিক দলেও মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় দেওবন্দ নেসাবের অনুসরণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাদরাসাও রয়েছে। এখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান দাওয়াত ও তাবলিগের কাজের সাথে যুক্ত। দেশটিতে ইসলামি আন্দোলনের ভিত্তিও বেশ মজবুত। আর লঙ্কান মুসলমানরা খুবই ধর্মপরায়ণ। প্রতি বছর প্রায় তিন হাজার মুসলমান শ্রীলঙ্কা থেকে হজ পালন করে থাকেন যদিও শ্রীলঙ্কান মুসলমানরা সৌদি আরবের কাছে হজের কোটা বাড়ানোর আবেদন করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরেই। গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কার নতুন সংবিধানে সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তার পরও দেশটিতে মুসলিম বিদ্বেষ বাড়ছে। সঙ্কুচিত হচ্ছে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক মর্যাদা, যা দেশটিতে বসবাসরত মুসলিমদেরকে অনিরাপদ করে তুলেছে।
শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের দ্বীনি তাবলিগের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে প্রচুর সামাজিক কাজের সাথে জড়িত যা তাদের দিয়েছে আলাদা পরিচিতি ও বিশেষ মর্যাদা। সব মিলিয়ে বলা চলে, সেখানকার মুসলমানরা বেশ ভালোই ছিলেন স্বকীয়তা ও পরিচিতি নিয়ে। কিন্তু সে অবস্থার এখন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। সম্প্রতি দেশটিতে মুসলিম বিদ্বেষ আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এ জন্য বর্তমান সরকারের মুসলিমবিদ্বেষী নীতিকে প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে।
দেশটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার সঙ্কুচিত করা হচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে। চলমান বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ সে দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। নানা অজুহাতে দেশটিতে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর অনাকাক্সিক্ষতভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। এমনকি হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে ইবাদত-বন্দেগিতেও। সে ধারাবাহিকতায় করোনার অজুহাতে দেশটির মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের প্রবেশাধিকার খুবই সীমিত করা হয়। কলম্বোর গল হাইওয়ে রোডের পাশে লোয়ার বারাতেল্লি সড়কে অবস্থিত আল হাসাদ মসজিদে জুমার দিনে ৫০ জনের অধিক মুসল্লি সেখানে প্রবেশের অধিকার পায় না। এটিই হচ্ছে সেখানকার বাস্তবচিত্র। আরব সাগরের কলম্বোর এ অংশের উপকূলঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এই চারতলা মসজিদে পুরুষ ও মহিলা মিলে হাজারখানেক মুসলমান নামাজ পড়তে পারে। কিন্তু করোনার অজুহাত দেখিয়ে এখন মাত্র ৫০ এর সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। জুমার সময় ৫০ জন মুসল্লিকে মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হলেও অন্য ওয়াক্তের নামাজে ৪০ জনের বেশি অনুমতি পান না। কলম্বোজুড়ে থাকা অসংখ্য মসজিদে এ নিয়ম। অথচ বাস ও ট্রেনের মতো গণপরিবহন চলছে, কলম্বোতে আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে, ছোট গ্যালারি দর্শকে পরিপূর্ণ। চলছে অফিস-আদালত ও মার্কেট। ঠাসাঠাসি করে যাত্রী নিয়ে চলছে বাস, খোলা শপিংমল। খুলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। কিন্তু নিয়মের কড়াকড়ি শুধু মসজিদে। এতে বিরক্ত শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা যা দেশটিতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ।
বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারীর শুরুতে খুবই নাজুক অবস্থার মুখে পড়েছিল লঙ্কার মুসলমানরা। করোনায় শ্রীলঙ্কার কোনো মুসলমান মারা গেলে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলা হতো। বিপুলসংখ্যক মুসলমানের লাশ এভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে করোনায় মৃত্যুর অজুহাতে। এরপর সোচ্চার হয় স্থানীয় মুসলমানরা। তাদের তুমুল আন্দোলনের মুখে মুসলমানদের লাশ পুড়িয়ে ফেলার নীতি থেকে সরে আসে মাহিন্দা রাজাপাকসে সরকার।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, মুসলিমদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা শুরু হলে পার্লামেন্ট ভবনের সামনে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়; যদিও করোনার দোহাই দিয়ে মুসলমানদেরকে আন্দোলন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। লাশ পোড়ানোর বিরুদ্ধে মুসলমানদের তীব্র আন্দোলনের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মুসলিম দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা চাপ দেন লঙ্কান সরকারকে। অনেকটা বাধ্য হয়েই দেশটির সরকার মুসলমানদের লাশ পোড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
শুধু কলম্বো শহরেই প্রচুর মুসলমানের বসবাস রয়েছে। এ ছাড়াও দেশের সব অঞ্চলেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানের বসবাস। শ্রীলঙ্কার মুসলমানরা আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল। বেশিরভাগই ব্যবসায়ী। মুসলমানদের অর্থনৈতিক শক্তিটা পছন্দ করছে না বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী সিংহলিরা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় একেশ্রেণীর উগ্রবাদী বৌদ্ধ প্রতিনিয়তই মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করছে। আগের সরকারগুলোর সময় বেশ কয়েকজন মুসলমান মন্ত্রী ছিলেন। সিরিসেনা সরকারের সময় এই সংখ্যা ছিল ছয়। কিন্তু রাজাপাকসে সরকারে মুসলমান মন্ত্রী মাত্র একজন যা ক্ষমতাসীনদের মুসলিম বিদ্বেষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
লঙ্কান মুসলমানদের অন্যতম ব্যবসা বিদেশ থেকে টাইলস আমদানি। এখন এই ব্যবসা বন্ধ করতে নানা ধরনের শর্তকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার, এমন অভিযোগও রয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে কলম্বোর এক গির্জায় বোমা হামলা চালানো হলে অনেক লোক নিহত হয়। এ ঘটনার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুসলমানদেরই দায়ী করা হয়। ফলে দেশটির মুসলমানরা নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। পরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষ ছড়ানো হয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তাদের ধর্মীয় ও নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়। আর এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। ফলে লঙ্কান মুসলমানরা এখন বিষম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
মূলত দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় মুসলিম জনসংখ্যা যতই বাড়ছে, ততই পরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষও ছড়ানো হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রোধ করার জন্য ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে একটি ধর্মান্ধ ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নানাবিধ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ অবস্থায় লঙ্কান মুসলমানদের অধিকার রক্ষায় বিশ্ব মুসলিমকে এগিয়ে আসতে হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে। বিশেষ করে ওআইসি, আরব লিগসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ; অন্যথায় ঐতিহ্যবাহী লঙ্কান মুসলমানদের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।