কোন পাপের কি শাস্তি

  • মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। কারণ, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ

তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। কারণ, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ

পাপিকে তার পাপের শাস্তি ভোগ করতেই হবে। এ শাস্তি কেউ ভোগ করবে ইহকালে, কেউ ভোগ করবে পরকালে। আল্লাহতায়ালা কাউকে স্বীয় দয়ায় ক্ষমাও করে দিতে পারেন। পার্থিব জগতে কোন পাপের কি শাস্তি হয় এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন- ১. কোনো জাতির মধ্যে আত্মসাৎ বৃদ্ধি পেলে সে জাতির লোকদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করা হয়। ২. কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। ৩. কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিমাপ ও ওজনে কম দিলে তাদের রিজিক সঙ্কুচিত করা হয়। ৪. কোনো জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে বিচার-ফায়সালা করলে তাদের মধ্যে রক্তপাত বিস্তৃতি লাভ করে। ৫. কোনো জাতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আল্লাহ শত্রুদেরকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেন। -মুয়াত্তা মালেক : ১৩২৩

বর্তমান পৃথিবীতে অশান্তি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, দাবানল, করোনাভাইরাস ইত্যাদি সবই মানুষের অপকর্মের ফসল। এসব কিছু দিয়ে আল্লাহতায়ালা দুনিয়াতেই শাস্তির কিঞ্চিত নমুনা দেখাচ্ছেন। এবার জেনে নেওয়া যাক কিছু পাপ ও তার শাস্তির কথা।

বিজ্ঞাপন

অন্যের মাল আত্মসাৎ
আত্মসাৎ করা মারাত্মক গোনাহ ও জঘন্য অপরাধ। মালের মালিক ক্ষমা না করলে এ গোনাহ আদৌ ক্ষমা হবে না। তাকে অবশ্যই জাহান্নামের অনলে জ্বলতে হবে। হজরত জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করে। পরে সে মারা গেলে নবী কারিম (সা.) তার জানাজা পড়াননি। সাহাবিদের বললেন, তোমাদের এ সঙ্গী আল্লাহর পথের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাতে একটি রেশমী বস্ত্র পেলাম যার মূল্য হবে দুই দিরহাম। -মিশকাত : ২৪২

ব্যভিচার
ব্যভিচারের শাস্তি ভয়ানক। হাদিস শরিফে রয়েছে, ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায়, আর তিনটি আখেরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো- ১. সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া; ২. দরিদ্র্যতা; ৩. অকাল মৃত্যু। আর আখেরাতের তিনটি হলো- ১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি; ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা এবং ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি। -ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ইফা : ১০৯

বিজ্ঞাপন

আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। কারণ, তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ -সুরা বনি ইসরাইল : ৩২

হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘কোনো বান্দা যখন ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তখন তার ভেতর থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং এটি তার মাথার ওপর মেঘখণ্ডের মতো ভাসতে থাকে। অতঃপর সে যখন তওবা করে, তখন ঈমান পুনরায় তার কাছে ফিরে আসে।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৪৬৯০

ওজনে কম দেওয়া
পরিমাপে ও ওজনে কম দেওয়া নিষেধ। এটি জঘন্যতম খেয়ানত ও গোনাহে কবিরা। এর ফলে আল্লাহতায়ালা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেন এবং দুর্ভিক্ষ ঘটান। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়, যারা লোকের কাছ থেকে ওজন করে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে আর যখন মানুষকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’-সুরা মুতাফফিফিন : ১-৩

নবী কারিম (সা.) যখন হিজরত করে মদিনায় যান, তখন সেখানে আবু জুহায়লা নামক এক ব্যবসায়ী ছিল। তার দোকানে ছিল দু’টি পাল্লা। একটি দিয়ে সে অন্যের জিনিস মেপে রাখত, আরেকটি দিয়ে মানুষকে মাল মেপে দিত। তারই প্রসঙ্গে উল্লিখিত আয়াতটি নাজিল হয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) একদা পরিমাপকারী ও দাঁড়িপাল্লা দ্বারা ওজনকারী ব্যবসায়ীদেরকে বললেন, তোমাদের ওপর এমন দু’টি জিনিসের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, যে জিনিসদ্বয়ের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতরা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।’-সুনানে তিরমিজি

বিচারে ইনসাফ না করা
অন্যায়, দুর্নীতি ও অসততা সর্বদা হারাম ও মারাত্মক অপরাধ। বিচারক সেজে বিচারকার্যে দুর্নীতি করা আরও জঘন্য অপরাধ। বিচারককে ইনসাফ ও সততা অবলম্বন করা অপরিহার্য। নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে শাসক আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুসারে বিচার করে না, আল্লাহ তার নামাজ কবুল করেন না।’-মুস্তাদরাকে হাকেম

হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, এক শ্রেণির বিচারক জান্নাতে যাবে, আর দুই শ্রেণীর বিচারক জাহান্নামে যাবে। যে বিচারক জান্নাতে যাবে, সে হলো- এমন বিচারক যে সত্য ও ন্যায়কে যথার্থ উপলব্ধি করে এবং তদনুযায়ী বিচার করে। পক্ষান্তরে, যে বিচারক সত্যকে যথার্থ উপলব্ধি করেও ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় রায় প্রদান করে, সে জাহান্নামি। তদ্রুপ যে বিচারক সত্যকে যথার্থ উপলব্ধি না করে স্বীয় ইচ্ছানুযায়ী রায় দেয়, সেও জাহান্নামি।’-সুনানে আবু দাউদ

প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা
প্রতিশ্রুতি করলে তা পূরণ করা আবশ্যক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা নিষেধ ও গোনাহে কবিরা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো। কেননা, প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়ে তোমাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’-সুরা বনি ইসরাইল : ৩৪

নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। অনুরূপ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার মধ্যে দ্বীন নেই।’-মিশকাত : ১৫

দুর্ভোগ তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়

 

হিংসা করা
হিংসা নেকসমূহকে ধ্বংস করে দেয়। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, হিংসা পুণ্যকে এমনভাবে বিনষ্ট করে দেয়, যেমনিভাবে আগুন কাঠকে ভস্মীভূত করে দেয়।’-সুনানে আবু দাউদ

তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের মধ্যে (এক সময়) পূর্ববর্তীদের নৈতিক ব্যাধি বিস্তার লাভ করবে, আর তা হলো হিংসা ও বিদ্বেষ।’-জামে তিরমিজি

হিংসা থেকে বেঁচে থাকা ফরজ। কারণ, তা এমন নীরব অনল যা ক্রমে ক্রমে জ্বলে উঠে এবং মানুষের নেকসমূহকে ধ্বংস করে দেয়। অথচ মানুষের কোনো খবরই থাকে না যে, তার নেকসমূহ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।

সুদ ও ঘুষ খাওয়া
‘সুদের ৭০ প্রকার গোনাহ রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নতম গোনাহ হলো স্বীয় মায়ের সঙ্গে ব্যভিচার করা।’ –মিশকাত : ২৪৬
আর সর্বোচ্চ গোনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে জিহাদ করা। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যারা সুদ খায় (বিচার দিবসে) তারা সে ব্যক্তির ন্যায় দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।’-সুরা বাকারা : ২৭৫

ঘুষ আদান-প্রদান করা অভিশাপযোগ্য কাজ। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের প্রতি আল্লাহতায়ালার লানত।’-আন নিহায়া ফি গারিবিল হাদিস : ২/২২৬

মদ পান ও জুয়া খেলা
মদ পান ও জুয়া খেলা উভয় শয়তানের কাজ। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তি পূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্যবস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে।’ -সুরা আল মায়িদা : ৯০

মজুতদারি ও কালোবাজারি
মূল্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখা এবং কালোবাজারি সম্পূর্ণরূপে হারাম। নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমান হয়েও খাদ্যশস্য আটকিয়ে রাখে (মজুতদারি করে) আল্লাহতায়ালা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্যতা চাপিয়ে দেন।’-মিশকাত : ২৫১

চুরি করা
চুরি করা জঘন্য অপরাধ। চুরি সমাজের শান্তি থেকে বিদূরিত করে। এর শাস্তি হলো- কবজি পর্যন্ত হাত কেটে দেওয়া। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘পুরুষ চোর ও মহিলা চোর অপরাধের শাস্তিস্বরূপ উভয়ের হাত কবজি পর্যন্ত কেটে দাও।’-সুরা মায়িদা : ৩৮

ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। কারণ, চুরি হয় গোপনে। আর ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট হয় প্রকাশ্যে। এদের শাস্তি হলো- হত্যা, শূলে চড়ানো, হাত-পা কেটে ফেলা ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে লুটপাট করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’-মিশকাত : ৩১৩