ছোট বলে কোনো আমলকে অবহেলা নয়
জীবনচলার পথে পথে, ঘরে-বাইরে নানা জায়গায় ছোট ছোট পুণ্যময় এমন অনেক কিছু ছড়িয়ে আছে, যেগুলো নিজ নিজ ক্ষুদ্রতাসহ মানুষকে সফলতার পথে পৌঁছে দিতে পারে। আবার এমন অনেক ছোট পাপ রয়েছে, যেগুলো ক্ষুদ্র হলেও আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দেয় ঈমান-আমল সবকিছু।
পবিত্র কোরআনের ঘোষণাটি লক্ষ করুন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে সে তা-ও দেখবে।’ -সুরা যিলযাল : ৭-৮
আলোচ্য আয়াতে কেয়ামতের ময়দানের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ দুনিয়াতে ছোট-বড় যে কাজই মানুষ করুক, তা পাপের হোক আর পুণ্যের, গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে, নিজ নিজ আমলনামায় মানুষ সেদিন সবকিছু দেখতে পাবে। বড় বড় পাপ কিংবা পুণ্যের একটা সাধারণ হিসাব তো মানুষের থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর এমন অনেক কিছুই সেদিন আমলনামায় মানুষ দেখতে পাবে- যার প্রকাশ সে কল্পনাও করতে পারেনি। আমলনামার এ ব্যাপকতা দেখে মানুষের চোখমুখ থেকে তখন ঝরতে থাকবে বিস্ময়। বিশেষত যারা অপরাধী, পাপ ও অন্যায় যাদের বেশি, নিজেদের কৃতকর্মের এমন ধারণাতীত সংরক্ষণ দেখে তাদের মুখে উচ্চারিত হবে হতাশার সুর। কোরআনে কারিমের ভাষায়, ‘এবং আমলনামা উপস্থিত করা হবে। এতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত এবং তারা বলবে, হায়! দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! এ তো ছোট-বড় কোনোকিছুই বাদ দেয় না, বরং তা সবকিছুরই হিসাব রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না।’ -সুরা কাহফ : ৪৯
এখানে কেবলই অপরাধীদের কথা বলা হয়েছে। আর সুরা যিলযালের উপরোক্ত আয়াত দু’টিতে বলা হয়েছে, ছোট ছোট পাপ-পুণ্য উভয়ের কথা। পাপের যখন এমন হিসাব হবে, পুণ্য ও নেককাজের এ হিসাব তো ইনসাফের দাবি। আর আল্লাহ তো ইনসাফের বদলে ‘ইহসান’ ও দয়া করে নেক আমলকারীদের বেহিসাব প্রতিদানে পুরস্কৃত করবেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নেক আমলের ইচ্ছা করল, কিন্তু এখনও তা আমলে পরিণত করেনি; (ইচ্ছার কারণে) তার আমলনামায় একটি নেকি লেখা হবে। আর যে ব্যক্তি এ ইচ্ছাকে আমলে পরিণত করল তার আমলনামায় দশ থেকে সাতশ পর্যন্ত নেকি লেখা হবে। আর যদি কোনো গোনাহের ইচ্ছা করে; কিন্তু গোনাহটি না করে; তার আমলনামায় কিছুই লেখা হবে না। যদি গোনাহটি করে বসে, তাহলে কেবল তা-ই (একটি গোনাহ) লেখা হবে।’ -সহিহ মুসলিম : ১৩০
সুতরাং হিসাব যখন সব কিছুর হবে, ছোট কোনো বিষয়কে তাচ্ছিল্য করা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী কোনো সুস্থ বিবেকের কাজ হতে পারে না।
দুনিয়ার জীবনে চোখ বুলালে আমরা দেখব, কত ক্ষুদ্র বিষয় কতভাবে মানুষের জীবনকে সাজিয়ে তুলছে, মুগ্ধ ও আনন্দিত করছে! হাড়িভর্তি খাবারের স্বাদ স্বাভাবিক রাখার জন্যে লবণ দিতে হয় খুব সামান্য। সামান্য এ লবণটুকুর অভাবে দামি দামি খাবারের স্বাদ যেমন বিস্বাদে পরিণত হয়, আবার প্রয়োজনীয় বলে কেউ যদি এ লবণের পরিমাণ অনেক বাড়িয়ে দেয় তবে সে খাবারও চেখে দেখার সাধ্য হয় না কারও। একইভাবে নিভু নিভু একটু আগুন থেকেও অসতর্কতাবশত সৃষ্টি হতে পারে বড় অগ্নিকাণ্ড, জ্বলে-পুড়ে ছাই হতে পারে ঘর-বাড়ি-এলাকা, সামান্য একটু অসতর্কতায় হারিয়ে যেতে পারে কোটি টাকার সম্পদ, চোখের সামনে নাই হয়ে যেতে পারে বছরের পর বছর ধরে চালানো অবিরাম সাধনার ফল। ছোট বলে তাই কোনো কিছুকেই তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।
হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘ভালো কোনো কাজকেই তুচ্ছ মনে করবে না। সে কাজটি কাউকে এক টুকরো রশি দিয়ে সহযোগিতা করে হোক, কাউকে একটি জুতার ফিতা দিয়ে হোক, তোমার পানির পাত্র থেকে পানিপ্রত্যাশী কারও পাত্রে সামান্য পানি ঢেলে দিয়ে হোক, মানুষের চলার পথ থেকে কষ্টদায়ক কোনোকিছু সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে হোক, হাসিমুখে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে হোক, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সালাম দিয়ে হোক, পৃথিবীতে কোথাও কারও একাকীত্ব দূর করে দিয়ে হোক, কোনো কিছুকেই তুমি তুচ্ছ মনে করবে না। তোমার কোনো অন্যায়ের কথা জেনে কেউ যদি তোমাকে গালি দেয় আর তুমি জানো, তার মধ্যে এ দোষটি রয়েছে, তখন তুমি তাকে গালি দেবে না; এতে তার প্রতিদান তুমি পেয়ে যাবে, আর তার গোনাহ তার কাঁধেই থাকবে।’ -মুসনাদে আহমাদ : ১৫৯৫৫
অন্য হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা বর্ণিত হয়েছে এভাবে, ‘তুচ্ছ মনে করা হয়- এমন সব পাপ থেকে তোমরা বেঁচে থেকো। তুচ্ছ এসব পাপের দৃষ্টান্ত তো এমন, যেমন কিছু মানুষ একটি উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করল। তখন তাদের একজন একটি লাকড়ি নিয়ে এল। আরেকজন আরেকটি লাকড়ি নিয়ে এল। এভাবে তাদের এ পরিমাণ লাকড়ি সংগ্রহ হয়ে গেল, যা দিয়ে তারা তাদের রুটি সেঁকে নিতে পারে। সন্দেহ নেই, এ তুচ্ছ পাপগুলোতে যখন কেউ লিপ্ত হয় সেগুলো তাকে তখন ধ্বংস করে দেয়।’ -তাবারানি : ৫৮৭২
ছোট ছোট পুণ্য আর তুচ্ছ পাপ নিয়ে এই হলো- হাদিসের নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনের ভাষ্য আমরা উল্লেখ করেছি, মানুষের আমলনামায় ছোট-বড় সব আমলই সংরক্ষিত থাকবে এবং কেয়ামতের দিন এসব আমলের হিসাব হবে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়েরও হিসাব হবে।
দুনিয়ার ভালোমন্দ সব কাজের ফল আমাদেরকে ভোগ করতে হবে আখেরাতে। কাজ ভালো হোক আর মন্দ, ভালো কাজ করা আর মন্দ থেকে বাঁচা বা মন্দ থেকে আল্লাহর ক্ষমা লাভ করা- তা করে যেতে হবে এ দুনিয়াতেই। আখেরাতে নতুন করে আমল করার কোনো সুযোগ থাকবে না। দুনিয়ার অর্থবিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তিও কোনো কাজে আসবে না। কাজে লাগবে একমাত্রই দুনিয়ার আমল। কারও কোনো দেনা শোধ করতে হলেও তা আমলের বিনিময়েই করতে হবে। পরকালীন এ বাস্তবতাকে সামনে রাখলেও সহজে বুঝে আসে- ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমলকে তাচ্ছিল্য না করার বিষয়টি।
আরেকটি যুক্তির কথা হলো, নিয়মিত কোনো আমল যদি ছোটও হয়, ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘদিন করার ফলে এ ছোট আমলটির প্রতিদানও হয়ে যায় পাহাড়সম। আর ছোট আমল হলেও তা নিয়মিত করা- আল্লাহ পছন্দ করেন।