বালা-মুসিবতে মুমিনের প্রাপ্তি

  • মুফতি আবদুর রহীম, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অর্থ : আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি এবং ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে! তবে সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা ধৈর্যশীল

অর্থ : আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি এবং ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে! তবে সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা ধৈর্যশীল

বিভিন্ন সময়ে বালা-মুসিবত নাজিলের ঘূর্ণিতাণ্ডব দেখে কোনো মুমিনের হতাশ কিংবা উদ্বেগাকুল হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা বিপদ আগমনের পেছনে সক্রিয় যে কার্যকারণগুলো রয়েছে, তা সত্যিকারের কোনো মুমিনের জীবনকে কোনোমতেই আক্রান্ত করতে পারে না। প্রশ্ন হলো, তবে কি মুমিনের জীবনে বিপদ-আপদ ঘটে না? ঘটে, বরং অধিকহারেই ঘটে। তবে মুমিনের জীবনে বালা-মুসিবত আগমনের কারণগুলো ভিন্নধর্মী, কৌতূহলোদ্দীপক এবং প্রেরণাদায়ী।

এ সম্পর্কে নবী কারিম (সা.)-এর একটি হাদিস খুবই মনোহর এবং উৎসাহ জাগানিয়া! তিনি বলেছেন, ‘মুমিনের ব্যাপারটি বড় বিস্ময়কর! তার প্রতিটি কর্মেই রয়েছে কল্যাণের পরশ, যা মুমিন ব্যতীত অন্য কারও নসিবে জোটে না। তার জীবনে সুখের আগমন ঘটলে সে আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করে। ফলে সেটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর বিপদের ঝাঞ্ঝা নেমে এলে সে ধৈর্যধারণ করে। ফলে সেটাও তার জন্য কল্যাণবাহী।’ –সহিহ মুসলিম

বিজ্ঞাপন

মুমিনের জীবনে বিপদাপদ আগমনের উক্ত কার্যকারণ সম্পর্কে অল্পবিস্তর আলোচনা করা যেতে পারে। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী এবং পড়ুয়া ছাত্রটিকে যেমন শিক্ষক অন্যদের তুলনায় জটিল সব প্রশ্ন করে তার ধীশক্তি ও জ্ঞানচর্চায় অধিকতর যোগ্যতাকে ঝালাই করে নেন, তেমনি বিশ্বজাহানের মহান প্রতিপালক তার নেক বান্দাদের অনেক সময় নানারকম বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করে নেন তাদের ঈমানের দাবির যথার্থতাকে। কালামে পাকে যেমনটি বিঘোষিত হয়েছে, ‘আমি তোমাদের অবশ্যই পরীক্ষা করব ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি এবং ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে! তবে সুসংবাদ তাদের জন্য, যারা ধৈর্যশীল এবং বিপদের সময় বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহরই জন্য এবং আমাদের সবাইকে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে।’ –সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৬

নবী কারিম (সা.)-এর একটি হাদিসেও আমরা বিষয়টির উল্লেখ দেখতে পাই এভাবে, ‘আল্লাহ কোনো বান্দার কল্যাণ চাইলে তাকে বিপদগ্রস্ত করেন।’ –সহিহ বোখারি

বিজ্ঞাপন

কখনও কখনও বান্দার পাপরাশি ক্ষমা করার করুণাসিঞ্চিত উপলক্ষেই দয়াময় প্রভু বান্দার ওপর মুসিবত দিয়ে থাকেন। নবীজির বর্ণনায়, ‘মুসলিম ব্যক্তির ওপর যে সব বিপদাপদ আসে সেসব দ্বারা আল্লাহ তার পাপরাশি ক্ষমা করে দেন, এমনকি যে কাঁটা তার শরীরে বিদ্ধ হয়, তা দ্বারাও।’ –সহিহ বোখারি

আবার অনেক সময় বালা-মুসিবতকে ব্যবহার করা হয় মুমিনের মর্যাদা বৃদ্ধির হেতু হিসেবে। পবিত্র কোরআনে যেমনটি ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমার পূর্বে আমি আনেক জাতির কাছে রাসুল পাঠিয়েছি, অভাব-অনটন আর দুঃখ-কষ্ট দিয়ে তাদের পাকড়াও করেছিলাম; যাতে তারা বিনীত হয়।’ –সুরা আনআম : ৪২

মানবতার মহান শিক্ষক হজরত মুহাম্মদ (সা.) এ বিষয়ে যে সরল বর্ণনা প্রদান করেছেন তা এরকম, ‘বিপদ যত তীব্র হবে প্রতিদানও তদানুসারে বিরাট হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতিকে ভালোবাসলে তাদের পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। যারা তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি আর যারা তাতে অসন্তুষ্ট থাকে, তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর অসন্তুষ্টি।’ -ইবনে মাজাহ

প্রখ্যাত মনীষী ফজল বিন সাহল (রা.) বলতেন, ‘অনেক বিপদ ও কষ্ট এমন রয়েছে যেগুলো মূলত বুদ্ধিমানদের জন্য একান্ত উপহার। এসব মুসিবতের মাধ্যমে পাপরাশি ক্ষমা করা হয়, সবর এখতিয়ার করার সওয়াব পাওয়া যায়, উদাসীনতা থেকে সজাগ হওয়া যায়, সুস্থতা ও শান্তির গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়, তওবার জন্য সতর্কতা আর দান-সদকার তাগাদা লাভ করা যায়।

তাই জীবন চলার পথে যেকোনো পর্যায়ে বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে হা-হুতাশ না করে বরং মহান প্রতিপালকের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে আত্মনিবেদিত থাকাই মুমিনের একমাত্র কাজ। প্রসঙ্গত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সে পরম আশাব্যঞ্জক হাদিসের উল্লেখের মাধ্যমে আমরা বিষয়টির সমাপ্তি টানতে চাই, যেখানে তিনি মুমিনের উদাহরণ দিয়েছেন ছোট চারাগাছের সঙ্গে। চারাগাছ যেমন সবসময় বায়ূপ্রবাহে এদিক-ওদিক হেলেদুলে থাকে, তেমনি মুমিনের জীবনেও ছোটখাটো কষ্ট ও বিপদ লেগেই থাকে। যাতে সে সবসময় আল্লাহমুখী থাকে এবং অসংখ্য সওয়াবের অধিকারী হতে পারে। আবার নবীজি (সা.) আমলবিহীন পাপিষ্ঠদের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন শক্ত বৃক্ষের সঙ্গে- সামান্য বাতাস যার গায়ে লাগে না সত্য, কিন্তু প্রমত্ত ঘূর্ণিঝড় তাকে একেবারে সমূলে উৎখাত করে দেয়।

বস্তুত মানবজাতির মহান শিক্ষক হজরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনের প্রতিটি বিষয়ে যে নিয়ম বাতলে দিয়েছেন এবং নির্দেশ করেছেন যে উপায়, সেটাই একমাত্র অনুসরণযোগ্য। কেননা তার চেয়ে উৎকৃষ্টতর কিছু হতে পারে, তা চিন্তা করাটাই বাতুলতা। বালা-মুসিবত উত্তরণেও তার শিক্ষা, কাজ ও নীতি-আদর্শ দুনিয়াবাসীকে শান্তি, স্বস্তি ও প্রেরণা জোগাবে, প্রগাঢ় তিমিরাচ্ছন্নতার মাঝে বিলাবে আলোক শুভ্রতা।