হাদিসে বর্ণিত কিছু ফিতনা
ফিতনা শব্দটি আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। শব্দটি আমাদের কাছে বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত হলেও এর সঠিক অর্থ আমরা অনেকেই জানি না। ফিতনা থেকে বাঁচতে হলে ফিতনা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। জানতে হবে ফিতনার আলামতগুলো সম্পর্কে। হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বীয় উম্মতদের ফিতনার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিভিন্ন হাদিসে ফিতনার বিভিন্ন আলামত সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। নিম্নে এ ধরনের কিছু হাদিস তুলে ধরা হলো-
ইলম উঠে যাওয়া
ইলম উঠে যাওয়া কিয়ামতের অন্যতম আলামতগুলোর একটি। পাশাপাশি এটি উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে পড়া ভয়াবহ একটি ফিতনা। মানুষ আলেমদের অবমূল্যায়ন করতে শুরু করবে। ফলে প্রকৃত ইলম আস্তে আস্তে উঠে যাবে। মানুষ বিভ্রান্ত হতে থাকবে। সবাই নিজেকে আল্লামা ভাবতে শুরু করবে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘অবশ্যই কিয়ামতের আগে এমন একটি সময় আসবে যখন সব জায়গায় মূর্খতা ছড়িয়ে পড়বে এবং ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি : ৭০৬২
মুসলমানদের মধ্যে লড়াই
বর্তমানে রাজনৈতিক কিংবা ব্যক্তিগত কারণে মুসলমানরাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। একে অপরকে দমানোর জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে পিছপা হয় না। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে এমন বিবাদে জড়ানোকে ফিতনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আহনাফ ইবনে কায়স (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (সিফফিনের যুদ্ধে) এক ব্যক্তিকে (আলী রা.)-কে সাহায্য করতে যাচ্ছিলাম। আবু বাকরাহ (রা.)-এর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি বললেন, কোথায় যাচ্ছ? বললাম, আমি এ ব্যক্তিকে সাহায্য করতে যাচ্ছি। তিনি বললেন, ফিরে যাও। কারণ আমি আল্লাহর রাসুল (সা.) কে বলতে শুনেছি, দুই জন মুসলমান তাদের তরবারি নিয়ে মুখোমুখি হলে হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ে জাহান্নামে যাবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! এ হত্যাকারী (তো অপরাধী), কিন্তু নিহত ব্যক্তির কী অপরাধ? তিনি বললেন, (নিশ্চয়ই) সেও তার সাথিকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব ছিল।’ -সহিহ বোখারি : ৩১
হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়া
শুধু তাই নয়, হজর রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন, দুনিয়া ধ্বংস হবে না যে পর্যন্ত না মানুষের কাছে এমন এক যুগ আসে, যখন হত্যাকারী জানবে না যে কি দোষে সে অন্যকে হত্যা করেছে এবং নিহত লোকও জানবে না যে কি দোষে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। জিজ্ঞেস করা হলো, কিভাবে এমন অত্যচার হবে? তিনি জবাবে বললেন, সে যুগটা হবে হত্যার যুগ। এরূপ যুগের হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি উভয়েই জাহান্নামি হবে। -সহিহ মুসলিম : ৭১৯৬
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও বড় বড় দালান
ফিতনার যুগে প্রযুক্তিগত দিক থেকে মানুষ অনেক দূর এগিয়ে যাবে। বড় বড় দালানকোঠা হবে, পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করা হবে। যা বর্তমানে আমরা খুব স্বাভাবিক বিষয় হিসেবেই দেখছি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন মক্কা শরিফের টিলার উদর বিদীর্ণ করা হবে আর নির্মিত ভবনগুলো মক্কা শহরের পাহাড়গুলোর চেয়ে উঁচু হবে তখন মনে কর ফিতনার সময় সন্নিকটে। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৭/৪৬১
পূর্বেকার হাদিসের ব্যাখ্যাকাররা আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, এখন তো মক্কা শরিফ পাথুরে ভূমি এবং পাহাড়ি এলাকা, তবে ভবিষ্যতে কোনোকালে আল্লাহ এ শহরে নদী এবং খাল-বিল সৃষ্টি করবেন। কিন্তু আজকের সুরঙ্গ পথগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, কিভাবে মক্কা নগরীর টিলাগুলো বিদীর্ণ করা হয়েছে।
হজরত আলী (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যখন আমার উম্মতের মাঝে বারোটি (কোনো কোনো বর্ণনায় পনেরোটি) কাজ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে তখন তাদের ওপর মসিবতের পাহাড় ভেঙে পড়বে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, কাজগুলো কী? উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন- ১. যখন রাষ্ট্রীয় সম্পদকে লুটের মাল মনে করা হবে...। ২. যখন আমানতের মালকে লুটের মাল মনে করা হবে এবং তাতে খেয়ানত করবে। ৩. যখন লোকেরা জাকাতকে জরিমানা এবং ট্যাক্স মনে করবে। ৪. মানুষ স্ত্রীর আনুগত্য করবে এবং মায়ের অবাধ্যতা করবে অর্থাৎ মানুষ স্ত্রীকে খুশি করার জন্য মাকে অসন্তুষ্ট করবে। ৫. মানুষ বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে এবং বাবার সঙ্গে অসদ্ব্যবহার করবে অর্থাৎ বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ করবে কিন্তু বাবার সঙ্গে রূঢ় ও কঠোর আচরণ করবে। ৬. মসজিদে শোরগোল হবে। ৭. সমাজের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ও নীচ ব্যক্তিকে নেতা বানানো হবে। ৮. অনিষ্টের ভয়ে মানুষকে সম্মান করা হবে। ৯. ব্যাপকভাবে মদ পান করা হবে। ১০. ব্যাপকভাবে রেশমি কাপড় পরিধান করা হবে। ১১. ঘরে নর্তকী ও গায়িকা রাখা হবে এবং বাদ্যযন্ত্র ও নাচ-গানের উপকরণকে যত্নসহকারে রাখা হবে। ১২. এ উম্মতের পরবর্তী লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের ওপর অভিসম্পাত করবে।
হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) এ আলামতগুলো বর্ণনা করে বলেন, এ আলামতগুলো যখন মুসলিম সমাজে দেখা দেবে তখন মসিবতের পাহাড় ভেঙে পড়বে। এ আলামতগুলোর বেশিরভাগই বর্তমান সমাজে বিদ্যমান। আমাদের সমাজে এমন অনেক বিষয় আছে যা আমাদের জিম্মি করে ফেলেছে। নিম্নে সেগুলোর কয়েকটি তুলে ধলা হলো-
মাদক : বর্তমান যুগে সত্যিই মদকে মদ মনে করা হয় না। বিভিন্ন নাটক-সিনেমায় মদকে অত্যন্ত হালকা করে প্রদর্শন করা হয়। বাবা-ছেলে একসঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবে মদ খাচ্ছে, এমন চিত্র প্রদর্শন করা হয়। বিভিন্ন পার্টিতে এখন মদ রাখা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, সারা বছর মদ পান না করলেও কেউ কেউ বিভিন্ন দিবসে পার্টির নামে মদ পান করছে। প্রায় পত্রিকাগুলো খুললে রিপোর্ট পাওয়া যায়, আস্তে আস্তে নারীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
সুদ : সুদ সমাজে এতটাই ব্যাপক হয়ে গেছে যে, মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে- সুদবিহীন অর্থনীতি চিন্তা করা যায় না। সুদ ব্যবস্থা বন্ধ করতে গেলে অর্থনীতিই ভেঙে পড়বে। অথচ পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম।’ -সুরা বাকারা : ২৭৫
ঘুষ : যখন আমার উম্মত ঘুষকে গিফট ও উপহার বলে হালাল করবে...। কেউ কেউ ঘুষকে বলেন, স্পিড মানি। আজকাল ঘুষদাতা গিফট দিলাম বলে ঘুষ দিচ্ছে এবং ঘুষ গ্রহণকারী গিফট বলেই তা গ্রহণ করছে অথচ এটি ঘুষ। যখন আমার উম্মত জাকাতের মালকে ব্যবসার মাল রূপে গণ্য করবে তখন উম্মতের ওপর ধ্বংস নেমে আসবে। এ চারটি বিষয় আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) উল্লেখ করেছেন। এগুলো এখন সমাজে দেখা যাচ্ছে।
ফিতনার যুগে করণীয়
আমরা এখন হয়ত সেই যুগেই পদার্পণ করছি। কোথাও কোনো শান্তি নেই। সবাই পাপের সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছে। অনিয়মই হয়ে যাচ্ছে নিয়ম। ধর্মভীরুতা হয়ে যাচ্ছে আনস্মার্টনেস। কঠিন কবিরা গোনাহের কাজগুলো হয়ে যাচ্ছে প্রগতিশীলতা। সুদ, ঘুষ, চুরি, ডাকাতি, গিবত সবই এখন নিত্যদিনের কাজ। এখন মানুষ গোনাহকে আর গোনাহ মনে করে না- নাউজুবিল্লাহ। আল্লাহর নাফরমানি করাই হয়ে উঠছে ফ্যাশন। যার কারণ বিশ্বব্যাপী নেমে এসেছে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে আমাদের আবারও ফিরে যেতে হবে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর দেখানো পথে।
এখনই নিজেদের সংশোধন করতে হবে, যাবতীয় গোনাহ থেকে বিরত থেকে সর্বদা আল্লাহর দরবারে তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। চোখের গোনাহ, অশ্লীলতা ও উলঙ্গপনা, অন্যকে কষ্ট দেওয়া, অন্যের হক নষ্ট করা, সুদ ও ঘুষের গোনাহ থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে। এ ধরনের অপরাধের ব্যাপারে সর্বদা নিজ পরিবার-পরিজন ও বন্ধু মহলকে সতর্ক করতে হবে। সেই সঙ্গে ফিতনা থেকে বেঁচে থাকতে মহান আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে।
ফিতনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রিয় নবী (সা.) স্বীয় উম্মতদের এমন একটি দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল ফিতানি, মা-জহারা মিনহা ওয়া মা বাতানা।’
অর্থ : ‘হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল ফিতনা থেকে পরিত্রাণ চাই।’ -মুসনাদে আহমাদ : ২৭৭৮