ইসলামের আলোকে সংবাদ ও সাংবাদিকতা

  • আবু নুসাইবা, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সংবাদ প্রচার করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য

স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সংবাদ প্রচার করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য

ইসলামে সাংবাদিকতা একটি আমানত। আর এ আমানত হচ্ছে, যেকোনো তথ্য ও সংবাদকে বস্তুনিষ্ঠভাবে গণমাধ্যমে তুলে ধরা। নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মতের রঙচঙ মাখিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা কিছুতেই ইসলাম সমর্থিত নয়। এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো, কোনোরূপ সংযোজন-বিয়োজন ছাড়াই সংবাদ পরিবেশন করা এবং সংবাদের অঙ্গসজ্জায় কেবল নিরেট সত্যকেই তুলে ধরা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদাররা! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো।’ -সুরা আহজাব : ৭০

খবরের সত্যতা যাচাই
কোনো ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও সভ্যতাই মানুষকে মিথ্যাবাদী হতে শেখায় না। ইসলামও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলামে মিথ্যা বলা মহাপাপ। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের কবিরা গোনাহ সম্পর্কে অবহিত করব না? কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, হে আল্লহর রাসুল! হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা এবং মা-বাবার অবাধ্য হওয়া। এরপর হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে রাসুল (সা.) বললেন, মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা।’ -সহিহ বোখারি

বিজ্ঞাপন

তাই সংবাদের তথ্য যাচাই ও সত্যতা নিরূপণ করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনরা, যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। যাতে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে যাতে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হতে না হয়।’ -সুরা হুজরাত : ৬

নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যা শুনবে, তা-ই (যাচাই করা ছাড়া) বর্ণনা করা মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ -সহিহ মুসলিম

বিজ্ঞাপন

তথ্য গোপন রোধ
ব্যক্তিস্বার্থ, দলীয় স্বার্থ কিংবা নিজস্ব চিন্তা-চেতনাবিরোধী হওয়ায় অনেকে প্রাপ্ত তথ্য গোপন করে থাকে। এমনটি কিছুতেই কাম্য নয়। সত্য গোপন করাকে ইসলাম পাপ হিসেবে বিবেচনা করে। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা সাক্ষ্য গোপন কোরো না, আর যে ব্যক্তি তা গোপন করে, অবশ্যই তার অন্তর পাপী।’ -সুরা বাকারা : ২৮৩
নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল করুন, যে আমার কথা শুনে অতঃপর তা হুবহু ধারণ করে অবিকল অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়।’ -জামে তিরমিজি

কারও চরিত্রে কালিমালেপন নিষিদ্ধ
ব্যক্তিগত আক্রোশে কাউকে হেয় করার মানসে কারও একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই গর্হিত কাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের কখনো যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে।’ -সুরা মায়েদা : ৮

হাদিস শরিফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি নিজ ভাইয়ের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহতায়ালা কেয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’ -সহিহ বোখারি

তবে ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি যদি এমন পর্যায়ের হয় যে, তার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তি, মানবসমাজ কিংবা রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার অত্যাচার, দুর্নীতি ও প্রতারণা থেকে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে তার আসল চেহারা তুলে ধরতে অসুবিধা নেই। এ বিষয়ে ইসলাম বিশেষ ছাড় দিয়েছে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ মন্দ কথার প্রচার-প্রসার পছন্দ করেন না, কিন্তু যার ওপর জুলুম করা হয়েছে (তার কথা ভিন্ন)। -সুরা নিসা : ১৪৮

প্রখ্যাত তাফসিরবিদ আল্লামা মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘এ আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, নিপীড়িত জনতার সপক্ষে গিয়ে জালিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা এবং বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ করা বৈধ।’

ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষ সংবাদ
সাংবাদিকতা ইসলামি দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, আর তা কিছুতেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য সীমাবদ্ধ নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি বলো, হে মানবসমাজ, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সবার কাছে আল্লাহর রাসুল।’ -সুরা আরাফ : ১৫৮

কাজেই সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র-শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়েই সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো সম্প্রদায়কে প্রাধান্য দেওয়ার সুযোগ নেই ।

সত্য প্রকাশে আপসহীনতা
কোনো শক্তির কাছে মাথা নত না করে ভয়শূন্য চিত্তে সংবাদ পরিবেশন করাই ইসলামের দাবি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য উচ্চারণ করাই উত্তম জিহাদ।’

অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত মুয়াজ (রা.) বললেন, রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, হে মুয়াজ, তুমি সত্য বলতেই থাকো, যদিও তা তিক্ত হয়।’ মূলত সত্য প্রকাশে আপসহীনতা একজন আদর্শ সাংবাদিকের অন্যতম কর্তব্য। সাংবাদিকরা নতজানু হয়ে কাজ করলে গণমাধ্যমের কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। ইসলাম সাংবাদিকের সত্য বলার অধিকার আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ বর্জন
পশ্চিমা সমাজে মিডিয়া পুঁজিবাদের প্রতি নতজানু এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজে মিডিয়া রাষ্ট্রের প্রতি দুর্বল। হাল আমলে বিভিন্ন দেশে বিশেষ রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ হয়ে সংবাদ প্রকাশের প্রতিযোগিতা চোখে পড়ার মতো। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা সীমালঙ্ঘন করেছে, তোমরা তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না; অন্যথায় জাহান্নামের আগুন তোমাদের স্পর্শ করবে।’ -সুরা হুদ : ১১৩

অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের কখনো যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে।’ -সুরা মায়েদা : ৮
ইসলামের নির্দেশনা হলো- পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ অবগত হওয়া
কোনো বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনের আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ইসলামি সাংবাদিকতার অন্যতম শর্ত। সুস্পষ্ট প্রমাণ ছাড়া বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা সম্ভব নয়। তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে সংবাদ প্রচার করা সাংবাদিকের অপরিহার্য কর্তব্য। এ বিষয়ে কোরআনের বক্তব্য এ রূপ- ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না; নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তর- এগুলোর প্রতিটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ -সুরা বনি ইসরাইল : ৩৬

যথোপযুক্ত শব্দচয়ন ও বাক্যের ব্যবহার
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণমাধ্যমে ভাষাকে কেবল লালনই করে না, বহু নতুন নতুন শব্দের সৃষ্টিও করে। ভাষাকে সহজ, সাবলীল ও সমৃদ্ধ করার মহৎ দায়িত্বটি গণমাধ্যমই নিরলসভাবে পালন করে। উদ্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপনে যথাযথ শব্দচয়ন বক্তব্য হৃদয়ঙ্গমে সহযোগিতা করে। অনদিকে যথার্থ শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে ব্যর্থ হলে ভুল বোঝাবোঝি ও জনমনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত অশ্লীল, কদর্য ও ব্যঙ্গাত্মক শব্দ পরিহার করা উচিত। ভাষিক আগ্রাসন ও শব্দ সন্ত্রাস রোধ করাও সাংবাদিকের দায়িত্ব। পবিত্র কোরআনের বাচনভঙ্গিমা, ভাষারীতি ও বাক্যবিন্যাস পদ্ধতি এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য অনুকরণের মডেল হতে পারে।